শাড়ি যেন নারীর মোহনীয়তার আরেক নাম। নারীকে মোহনীয় ও আকর্ষণীয় করে তুলতে শাড়ি এক অতুলনীয় এবং বিতর্কহীন পোশাক।
বারো হাতের শাড়ি নারী দেহের সাথে আটকে রাখে আকর্ষণীয়তা,মোহনীয়তা আর ঐতিহ্যের স্বাক্ষর।দিনের পর দিন বাঙালী নারীকে মোহনীয় রূপ দিতে একটুও অভাব রাখেনি শাড়ি।
এই পোশাকের বিভিন্ন নকশা ও রং নারীকে একেকভাবে তুলে আনে সবার সামনে।সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য শাড়ি প্রস্তুতকারীরা শাড়ির পাড় বা অন্যান্য অংশে বিভিন্ন ডিজাইন দেন।এসব ডিজাইন ও রং সাহায্য করে বিভিন্ন গড়নের দেহে তা মানিয়ে যাওয়ার জন্য।
একজন নারীকে লম্বা দেখাতে কিংবা খাটো দেখাতে যেমন বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি পরতে হয়,ঠিক তেমনি শাড়ির রংও ফুটিয়ে তোলে নারীর ব্যাক্তিত্বকে।যেমন মোটা পাড়ের শাড়িতে একজন নারীকে বেশিই মোটা দেখায়।তাই নিজেকে স্লীম দেখাতে চাইলে চিকন পাড় বা পাড়বিহীন শাড়ির বিকল্প নেই।
আবার আকর্ষণীয় করে তুলতে বা আধুনিকতার ছোয়া দিতে হাতাকাটা বা স্লিভলেস ব্লাউজের জুড়ি নেই।কিন্তু আপনার হাতে যদি মেদ বা চর্বি বেশি থাকে, তাহলে কিন্তু সৌন্দর্যটা না বাড়িয়ে কমিয়েই দিবে। তাই এই বিষয়টা মাথায় রেখে হাতাকাটা ব্লাউজ পরবেন কি পরবেন না,সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হাতে সামান্য মেদ থাকলে পরতে পারেন কোয়ার্টার বা ফুল হাতার ব্লাউজ।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
প্রাচীন আমলে সুতার ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। পরে সুতা ব্যবহার করে কাপড় তৈরি করা হয়। কাপড়ের ব্যবহার এবং সেটা পরার বিভিন্ন ধরন মূলত মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় শুরু। এছাড়া এই সুতা বা সেখান থেকে তৈরিকৃত কাপড় পরিধান করার ধরন মেসোপটেমীয় সভ্যতা থেকে মিশর, সুমেরীয়, আসেরীয় বা ইন্দু উপত্যকা সভ্যতায় ছড়িয়ে পড়ে।
ধারণা করা হয় সুতার ব্যবহারের এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে এক ধরনের লম্বা বস্ত্রখণ্ড তৈরি হয় যা দ্বারা তৎকালীন নারীরা শরীরের অংশ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ঢেকে রাখতেন। এই লম্বা কাপড় অবশ্যই ছিল সেলাইবিহীন। শরীরের নিচের অংশ ঢেকে রাখা এই কাপড়কে তখন নিভি বলা হতো।
আর্যরা যখন উত্তর ভারত থেকে প্রবেশ করেন এই অঞ্চলে তখন তারা এ ধরনের বস্ত্রখণ্ড ব্যবহার করা শুরু করেন এবং তখন সর্বপ্রথম কাপড়কে বস্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য তারা পূর্বে উল জাতীয় বা পশুর চামড়া থেকে তৈরি বস্তু দ্বারা শীত নিবারণ করতেন।
শাড়ি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত শব্দ সুতি বা সাতী (sati )থেকে যার অর্থ একখণ্ড বস্ত্র বা কাপড়।
ধারণা করা হয় যে ইন্দু উপত্যকা সভ্যতায় ওই সুতা বা কাপড় এর আগমন থেকেই শাড়ি বিস্তার লাভ করে। ১৮০০-২৮০০ খ্রিস্টপূর্ব এর মধ্যে যা মূলত ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিস্তারিত ছিল।
শাড়ির বিবরণ পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্র মহাভারত, রামায়ণ ও বেদ এর মধ্যে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে প্রথমত সুতার আবিষ্কার এবং সেখান থেকে কাপড় তৈরি হয়।
সে কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক রং লাগানো হতো যেমন নীল ও হলুদ। গাছের শিকড় থেকে প্রাপ্ত নির্যাস, মোম দ্বারা তৈরি উপাদান ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের জিনিস রং হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
ধারণা করা হয় চৌদ্দশ শতক পর্যন্ত পুরুষ ও নারী উভয়ে একখণ্ড কাপড় ধুতির মত করে পরিধান করতেন।
বিভিন্ন রকমের লেখা, প্রাচীন ছবি, ভাস্কর্য ও মূর্তিগুলো পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায় যে নারী-পুরুষ উভয়ই লম্বা বস্ত্রখণ্ড যা মূলত সুতা দিয়ে তৈরি অর্থাৎ সুতি কাপড় শরীরের নিচের অংশে পরিধেয় বস্তু হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে নারীরা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শরীরের উপরের অংশে আলাদা করে কোনো বস্ত্র ব্যবহার করতেন না।
ধুতির মত করে বা একটি বিশেষ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে (কাঁছা) (kaccha)যেটাই বলি, পরিধান করার বক্তব্য বারবার বিভিন্ন গবেষণায় ফুটে উঠেছে।
এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ভাবে শাড়ি পরা হয়। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে এভাবে শাড়ি পরাটা তাদের জাতীয় ঐতিহ্য।
ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশ হতে থাকে। সুতি কাপড়ের সাথে সাথে উদ্ভব হয় রেশমি সুতার। রেশমি সুতা বা রেশম কাপড়ের কদর ছিল সমাজের উঁচু স্তরে। অভিজাত ঘরের মহিলা ও পুরুষ উভয় এই কাপড় ব্যবহার করতেন।
বিশেষ করে এই রেশমি সুতা দিয়ে তৈরি শাড়ি উচ্চবিত্ত ঘরের নারীরা ব্যবহার করতেন। ভারত উপমহাদেশে মধ্যযুগে মুসলিম শাসন লাভ করে। তখন মুসলিম নারীরা রেশমী কাপড়ের সাথে সাথে আলাদাভাবে একটি কাপড় মাথা ঢাকার জন্য ধর্মীয় রীতিতে ব্যবহার করতেন। সেই অতিরিক্ত কাপড়ের ছিল নকশাদার, জরিযুক্ত পাড়।
প্রাচীন আমলে এই রেশমি সুতা বা রেশম কাপড়ের খুবই জনপ্রিয়তা ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যা আমাদের এই ভারত উপমহাদেশ থেকে রফতানি করা হতো।
পাভাদা, পেটিকোট, সায়া
শাড়ি পরার ক্ষেত্রে সহকারি বস্ত্র হিসেবে পেটিকোট ব্যবহার করা হয়। যাকে দক্ষিণ ভারতের পাভাদা বলে এবং পূর্ব ভারতে যাকে সায়া বলা হয়।
ব্লাউজ/চোলি/রাভিকা
শাড়ি পরার ক্ষেত্রে এটা আরেকটি উল্লেখযোগ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু। যা প্রাচীন আমল থেকে ব্যবহার করে আসা হচ্ছে। এর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নাম প্রচলিত আছে। শাড়ির আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে আমরা এই অঞ্চলে যাকে ব্লাউজ নামে চিনি। ভারতের কিছু অঞ্চলে তাকে চোলি বলা হয় এবং কিছু অঞ্চলে রাভিকা হিসেবে একে চেনা হয়। ব্লাউজ মূলত মুসলিম শাসনামলে এই উপমহাদেশে প্রচলিত হয় সাথে ব্রিটিশ আমলে এটা উল্লেখযোগ্য হারে ব্যবহৃত হতো।
পাল্লু বা আঁচল বা পাল্লাভ
শাড়ি একটি লম্বা বস্ত্রখণ্ড বারবারই বলা হচ্ছে। শাড়ি বিভিন্ন ভাবে পরার ধরণ থেকে অর্থাৎ প্রাচীন আমল থেকে বিভিন্ন ভাবে শরীরের সাথে পেঁচিয়ে বা ধুতির মত করে ব্যবহার করা হয়েছে। উক্ত ব্যবহারের নিয়ম এর মধ্য থেকে শাড়ির একটা অংশ যাকে আমরা এই দেশে আঁচল বলি সেটা ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত আমাদের দেশে আঁচল কাঁধের একপাশ থেকে ঝুলিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় বা কেউ কেউ এটাকে ঘোমটার মতো ব্যবহার করেন মাথায়। ভারতে এটাকে কিছু অঞ্চলে পাল্লু আবার কিছু অঞ্চলে পাল্লাভ বলা হয়।
অঞ্চলভেদে আঁচল বা পাল্লু বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা হয়। কখনো কখনো এটা কাধের পাশ থেকে ঘুরিয়ে সামনে এনে শরীরের সামনের অংশ ঢেকে রাখা হয়। কখনো কখনো বিশেষ কায়দায় এটি কোমর থেকে পেঁচিয়ে কোমরের অন্য অংশে গুজে রাখা হয়।
মূলত শাড়ি ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পরা হয়।
বাংলাদেশ
আমাদের দেশের নারীদের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্যগত পোশাক শাড়ি। যদিও প্রতিদিনের রুটিন জীবনের শাড়ি পরার চল অনেক কমে আসছে। তবুও আমরা যে কোনো অনুষ্ঠানে, ঐতিহ্যগত বিষয়ে, ধর্মীয় আয়োজনে শাড়িটাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমাদের এই ভারত উপমহাদেশের নারীগণের শারীরিক গঠন অনুযায়ী শাড়ি নামক এই লম্বা বস্ত্রখণ্ড সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটা পরিধান করার পর প্রত্যেক অঞ্চলের নারী অত্যন্ত কমনীয় সভ্য, সুন্দর হিসেবে উপস্থাপিত হয়। তাই যুগ যুগ ধরে অত্যন্ত শোভন এবং প্রধান পোশাক হিসেবে এই দেশে শাড়ির প্রচলন রয়েছে। আমাদের দেশের বিয়েতে নারীর প্রধান পোশাক শাড়ি।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য শাড়ি হলো:
১. টাঙ্গাইলের তাঁত
২. ঢাকাই জামদানি
৩. রাজশাহী সিল্ক
৪. ঢাকাই বেনারসি
৫. কাতান
ভারত
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু উল্লেখযোগ্য শাড়ি যা বাংলাদেশেও খুবই জনপ্রিয়, তা হলো—-
১. চিকান (chikan) (লখনৌ)
২.কান্জিভরম ( তামিলনাডু)
৩. বেনারসী (বেনারস)
৪. গাদোয়াল (অন্ধ্রপ্রদেশ)
৫. মাইসোর সিল্ক (কর্ণাটক)
৬. বালুচুরি (পশ্চিমবঙ্গ)
৭. পাইথানি (মহারাষ্ট্র)
পাকিস্তান
পাকিস্তানের নারীগণ শাড়ি পরিধান করেন। তবে বর্তমানে তা প্রচলন নেই বললেই চলে। এর পরও বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান বিশেষ করে অভিজাত সমাজে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীগণ শাড়িকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
শ্রীলংকা
এদেশে নারীগণ প্রধানত শাড়ি পরিধান করেন। তবে এদের শাড়ি পরার ধরন অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এরা মূলত প্রাচীন আমলে শাড়ি পরার মতো বা প্রাচীন ভারত উপমহাদেশে শাড়ি পরার ধরনের সাথে মিল করে এখনো পরিধান করেন। তবে শাড়ির একটি অংশ শরীরের পিছনের দিকে মাছের লেজের মত করে উল্টিয়ে গুঁজে রাখা হয় যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ( Fishtail)।
এদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকে এতদিন পর্যন্ত শাড়ি প্রধান পরিধেয় বস্ত্র বা পোশাক হিসেবে ব্যবহার করা হলেও এর তেমন কোনো ইতিহাস সমৃদ্ধ গবেষণা প্রবন্ধ পাওয়া যায় না। যা অতি আশ্চর্যের বিষয়। ভিন্ন ভিন্ন শাড়ি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন গবেষণা আছে যেমন ঢাকাই জামদানি, রাজশাহী সিল্ক ইত্যাদি।
ধীরে ধীরে কাপড় বা সুতায় আসে বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন। শাড়িকে শুধু ঢালাও লম্বা কাপড় হিসেবে দেখার চল উঠে যায়। সেখানে শুরু হয় বিভিন্ন রকমের কারুকার্য, নকশা। বসানো হয় মূল্যবান পাথর, মুক্তা ও পুতির কাজ। এর ফলে শাড়ির মধ্যে আসতে থাকে বৈচিত্র থেকে বৈচিত্র। যেটার ধারাবাহিকতা এখনো আমরা দেখতে পায়।
পোশাকের আধুনিকায়ন হলেও বাঙালি নারীর শাশ্বত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে কেবল শাড়িতেই। শাড়ির চিরন্তন আবেদন আজও অমলিন। ১২ হাত একখানা শাড়ির সৌন্দর্যের কাছে যেন হার মানে অন্য সব পোশাকই। আর তাই তো বাঙালি নারীদের কাছে শাড়ি খুব শখের একটি পোশাক।
শাড়ির মতো ফেমিনিন ড্রেস পৃথিবীতে আর নেই। একবিংশ শতাব্দীতেই নয় কেবল, শাড়ি যে বাংলার মেয়েদের পরিধেয় ছিল তা চৌদ্দ শতকেও প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই সময়ে কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন-
‘‘নীল শাড়ি মোহন কারী
উছলিতে দেখি পাশ,
কি আর পরানে সঁপিনু চরণে
দাস করি মনে আশ’’।
— সংকলিত