মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’: সংস্কৃতিজগতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বহুদিন ধরে উদযাপিত বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ঘোষণা করেছে সরকার। এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই সংস্কৃতিজন, শিক্ষার্থী, ইতিহাসবিদসহ নানা মহলে শুরু হয়েছে জোরালো প্রতিক্রিয়া এবং বিতর্ক।
সরকারি ঘোষণায় জানানো হয়, “মঙ্গল” শব্দটি নিয়ে ধর্মীয় বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, তাই আরও সমন্বিত, সার্বজনীন ও আনন্দঘন পরিবেশ নিশ্চিত করতে এ বছরের (২০২৫) বৈশাখী শোভাযাত্রার নাম ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ রাখা হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শুরু হয় ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তখনকার আন্দোলনের সাংস্কৃতিক রূপ হিসেবে এটি উদ্ভূত হয়। পরবর্তীতে এই শোভাযাত্রা হয়ে ওঠে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও ঐক্যের প্রতীক।
২০১৬ সালে ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে “Intangible Cultural Heritage of Humanity” বা “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বিতর্কের শুরু
নাম পরিবর্তনের ঘোষণার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা। অনেকেই বলেন, এই নাম পরিবর্তন শুধুই একটি শব্দের রদবদল নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, ইতিহাস ও চেতনার অবমূল্যায়ন।
চারুকলা অনুষদের এক শিক্ষক জানান, “মঙ্গল শোভাযাত্রা কেবল উৎসব নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব, পরিচয় ও প্রগতিশীল চিন্তার প্রতিফলন। আনন্দ তো উৎসবের অংশ, নাম পরিবর্তনে তা বৈচিত্র্য হারাবে।”
প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এই নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐতিহ্যকে প্রশাসনিকভাবে ঢেলে সাজানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা কাম্য নয়।”
ধর্মীয় ভিন্নমতের প্রভাব?
অনেকেই ধারণা করছেন, ধর্মীয় কিছু গোষ্ঠীর আপত্তি মেনে ‘মঙ্গল’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ভাষাবিদ ও ইতিহাসবিদরা বলছেন, ‘মঙ্গল’ শব্দটি বাংলাভাষায় শুভ ও কল্যাণকর অর্থেই ব্যবহৃত হয় এবং এটি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসকে নির্দেশ করে না।
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, “সংস্কৃতি কখনো চাপিয়ে দেয়া যায় না, বরং তা গড়ে ওঠে মানুষের অনুভব, ইতিহাস ও বোধের সমন্বয়ে। এ ধরনের পরিবর্তনে শিকড় কাটা পড়ে।”
ইউনেস্কোর স্বীকৃতির কী হবে?
ইউনেস্কো যে নামেই এই শোভাযাত্রাকে স্বীকৃতি দিয়েছে তা হলো – “Mongol Shobhajatra in Dhaka”। এখন নাম পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এখনো এ বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি।
সাধারণ মানুষের মত
বেশিরভাগ মানুষ এখনও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামেই এই উৎসবটিকে চেনেন ও ভালোবাসেন। এমনকি এই বছরও চারুকলা অনুষদের অনেক শিক্ষার্থী এবং পহেলা বৈশাখে অংশগ্রহণকারীরা ব্যানারে “মঙ্গল শোভাযাত্রা” নাম ব্যবহার করেছেন।
নাম পরিবর্তন সত্ত্বেও এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার চেতনা, রূপ ও শক্তি আগের মতোই রয়ে গেছে। তবে সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি সংবেদনশীলতা বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অনেকেই।
এই বিতর্কে হয়তো নতুন নাম এসেছে, কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা আজও লাখো মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছে তার স্বতন্ত্র পরিচয়ে।
–মোহাম্মদ মহসীন