বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে বিদেশীদের বহু ‘কিন্তু’ ছিলো। অথচ রাত পোহালে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভোট। এ কর্মযজ্ঞ দেখতে ইতোমধ্যেই দেশে এসেছেন ২০২ জন বিদেশী পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক। তারা বাংলাদেশে আসার জন্য নিবন্ধন করলেও পৌঁছেছেন ১০৯ জন।
এদের মধ্যে বিদেশী পর্যবেক্ষক রয়েছেন ৭৭ জন (নিবন্ধন করেছিলেন ১২৬ জন) এবং ৩২ জন বিদেশী পত্রিকার সাংবাদিক (নিবন্ধন করেছিলেন ৭৬ জন)। এই সাংবাদিকরা বিশ্বের নামীদামী গণমাধ্যমে কর্মরত। রবিবারের (৭ জানুয়ারি) ভোটগ্রহণ কতটা প্রাণবন্ত উৎসবমুখর হয় তা দেখতে তারা মুখিয়ে আছেন।
রবিবার (৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় সারাদিন বিভিন্ন কেন্দ্রে তারা কেমন ভোট দেখলেন তা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানাবেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিএনপি এই ভোট বর্জনের ডাক দিয়ে গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭১ দিনে সারা দেশে আন্দোলন শুরু করে ও ৩০৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়। এরমধ্যে ৩০৪টি যানবাহন ও ২৪টি স্থাপনা পুড়ানো হয়। তবে ঢাকা মহানগরীতে সবচেয়ে বেশি ১৩৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৮ জন নিহত হয়। ফায়ার সার্ভিসের দুই জনসহ আহত হয়েছে ৫ জন। এমন নাশকতা উপেক্ষা করেই রবিবার ভোট হবে।
কূটনীতিকরা বলেছেন, বাংলাদেশ গত ৫৩ বছরের ইতিহাসে যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে এবং চলমান ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ কৌশলগত অবস্থানে আছে তাতে দেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতি বিদেশিদের বাড়তি আগ্রহ রয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন বলেন, বাংলাদেশের এই নির্বাচনের প্রতি সকলেরই আগ্রহ রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের যে প্রত্যাশা করেছে সেটাও আমরাও করি। একাধিকবার আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। আশা করি, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।
এদিকে রাশিয়ার পক্ষ থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা ৩ সদস্যের একটি দলের প্রধান আন্দ্রে সুটভ বলেন, আইন অনুযায়ী নির্বাচন সম্পন্ন করা বাংলাদেশের দায়িত্ব। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে এই নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সমাবেশ করার অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ক্লেমন ভুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক্স বার্তায় বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে চারদিকে দমনমূলক কর্মকাণ্ড থাকায় আমি বিরক্ত। নির্বাচনের আগে ও পরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানাই।
নির্বাচনের আগে গত শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাতে ট্রেনে নাশকতার ঘটনায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারিয়া মাসদুপুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক্স বার্তায় বলেন, অনাকাঙ্খিতভাবে সহিংসতা আগেই শুরু হয়েছে। সর্বত্রই নাশকতা বিরাজ করছে।
ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশি বন্ধুদের আগ্রহ রয়েছে। বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর এই আগ্রহের পেছনে তাদের নিজেদের স্বার্থ কাজ করছে। এই নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো গত দুই বছর ধরে কমবেশি আগ্রহ প্রকাশ করছেন। পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত। আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন না হলে দেশটি ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে বলে দুইবার ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যকে সমর্থন করতে অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের ধারা ২১২(এ)(৩)(সি) (‘থ্রিসি’) এর অধীনে বাংলাদেশের ওপর গত ২৪ মে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন।
ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের উদ্ধৃতি দিয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে জানায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গত নভেম্বরে পশ্চিমের এই দেশটি নির্বাচনের আগে সবগুলো রাজনৈতিকদলের মধ্যে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানায়। সর্বশেষ বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের অধিকার ও তাদের মানোন্নয়ন নিয়ে নতুন স্মারকপত্র প্রকাশের পর গত নভেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন তার বক্তব্যে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিক নেতা কল্পনা আক্তারের কথা উল্লেখ করেন।
নির্বাচনের আগে ভ্রমণ সতর্কতায় ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বলেছে, ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস সেদিন বন্ধ থাকবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন নাগরিকদের সতর্কতা মেনে চলা উচিত হবে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন যদিও শান্তিপূর্ণ হবে বলেই আয়োজন করা হয়েছে। তবে তা সহিংসতায় রূপও নিতে পারে। ভোটগ্রহণের আগে, ভোটগ্রহণের দিন বা পরের দিন বা সপ্তাহগুলোতে সামান্য বা কোনো ধরনের পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির বিষয়ে বিদেশি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, তারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বিশ্বাস করে। যারা এক্ষেত্রে বাধা দেবে তাদের ওপর এই নীতি প্রয়োগ করবে। আমরা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করছি না। আমরা জানি না, কারা আগুন দিচ্ছে, মানুষকে হত্যা করছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের চেষ্টা করছি। আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত নই।
এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর বাংলাদেশের ভোট নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। তাছাড়া এশিয়ার বৃহৎ দুই পরা শক্তি চীন ও ভারত এই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে সবসময়েই সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে গত বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত বলে আসছি, দেশটির নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
কূটনীতিকদের সঙ্গে এক ব্রিফিং শেষে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) নির্বাচন ইস্যুতে বলেন, আমি মনে করি এটা সফল ও নির্ঝঞ্ঝাট নির্বাচন হবে। যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্যও মাইলফলক হবে।
একই ইস্যুতে ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম টোস্টার বলেন, শুরু থেকে আমার অনুধাবন যে তারা (নির্বাচন কমিশন) খুবই এবং সাধ্যমত কাজ করার চেষ্টা করছে। আমি মনে করি, তারা বেশ গুরুত্ব সহকারে কঠোর পরিশ্রম করছেন।
সূত্রঃ ভোরের কাগজ
Aninda, Sub-Editor