একটানা ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় এখনো দক্ষিণ চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকা বিশেষ করে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, দোহাজারী, কেনানিহাটের অধিকাংশ এলাকা এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। এসব এলাকার সড়ক-উপসড়কের পাশাপাশি ফসলি জমি, ঘর-বাড়ি, পুকুর এখনো পানিতে নিমজ্জিত।
এখনো পানিবন্দি হয়ে আছেন কয়েক লাখ মানুষ। দুর্ভোগে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ, স্থবির হয়ে পড়েছে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানিতে অধিকাংশ রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিকটস্থ কোন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ারও কোন উপায় নেই।
এদিকে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ও চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়ক দিয়ে বুধবার (৯ আগস্ট) সন্ধ্যা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে ছিল। পানি নামতে শুরু করলেও চন্দনাইশ ও সাতকানিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে ছিল।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের অন্তত ৪টি স্থানে তৈরি হয়েছে যানজট। সড়কের উভয় প্রান্তে আটকে পড়েছে কয়েকশ ছোট-বড় যানবাহন। পানিতে হেঁটে কিংবা নৌকা-ভ্যানগাড়িতে চড়ে লোকজনকে সড়ক পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।
অতি ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সোমবার (৭ আগস্ট) রাত থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় পানি বাড়তে শুরু করে। সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ ডুবে যাওয়ায় মঙ্গলবার সকাল থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে কক্সবাজার ও বান্দরবানের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দুইদিনেও যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, চন্দনাইশের হাশিমপুর বড়পাড়া থেকে কসাইপাড়া হয়ে সাতকানিয়ার কেরাণীহাট পর্যন্ত অংশ বুধবার দুপুরেও পানিতে তলিয়ে আছে। মহাসড়কে পানির স্রোত আছে। এরপরও লোকজন পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে কেউ বা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন, কেউ অন্য গন্তব্যে যাচ্ছেন। অনেকে ভ্যানগাড়িতে করে ঘরের আসবাবপত্র, হাঁস-মুরগি, ছাগল নিয়ে যাচ্ছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়কে সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া, বুড়ির দোকান, বায়তুল ইজ্জতসহ কয়েক কিলোমিটার এলাকা এখনও পানিতে তলিয়ে আছে।
স্থানীয়রা জানান, চন্দনাইশের জোয়ারা খানহাট থেকে গাছবাড়িয়া পর্যন্ত আটকে পড়েছে শতাধিক যানবাহন। এছাড়া বাগিচারহাট, দোহাজারী, সাতকানিয়া মৌলভীর দোকান, কেরাণীহাট বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রয়েছে তীব্র যানজট। অন্যদিকে কেরাণীহাট থেকে বান্দরবান সড়কের বাজালিয়া এলাকায়ও যানজট দেখা দিয়েছে।
এদিকে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়ায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বন্যার পানিতে। তিনদিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পুরো এলাকা।
চন্দনাইশের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিমরান মোহাম্মদ সায়েক জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের চন্দনাইশের হাশিমপুর, দোহাজারী, কেরানীহাটসহ বিভিন্ন এলাকা এখনও জলমগ্ন। তাই যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
চট্টগ্রাম হাইওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নাসিম খান বলেন, চন্দনাইশের দোহাজারি থেকে সাতকানিয়ার কেরাণীহাট পর্যন্ত এলাকায় অনেক যানবাহন বিকল হয়ে আছে। সড়কের ওপরেও বিকল যানবাহন আছে। প্রায় অর্ধেক ডুবন্ত অবস্থায় শত শত বাস, ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন এলাকায় মহাসড়কের পাশে।
তিনি বলেন, গত (মঙ্গলবার) রাত থেকে বৃষ্টিপাত তেমন হয়নি। এ জন্য পানি নেমে যেতে শুরু করেছে। এরপরও কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি আছে। বাস, ট্রাক, বড় যানবাহন চলাচল সম্ভব হচ্ছে না। তবে অটোরিকশা কিংবা পিকআপ ভ্যানের মতো ছোট ছোট দুই একটি গাড়ি পানির ভেতর দিয়েও চলাচল করছে। যদি বৃষ্টি আর না হয়, তাহলে রাতের মধ্যে পানি নেমে যেতে পারে। এরপর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হবে।
এদিকে বন্যাকবলিত চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নৌকা উল্টে তিন শিশুসহ চারজন নিখোঁজ আছেন। মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) উপজেলার চরতি ইউনিয়নের দক্ষিণ চরতি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
চরতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরী জানান, দক্ষিণ চরতি গ্রাম থেকে নৌকা নিয়ে নারী ও শিশুসহ আটজন পাশের সুঁইপাড়া গ্রামে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে পানির স্রোতে নৌকা উল্টে যায়। এতে সবার পানিতে পড়ে গেলেও চারজন নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হন। তিন শিশুসহ চারজন পানির স্রোতে তলিয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়। দুইদিনের মাথায় সেটা অতি ভারি বর্ষণে রূপ নেয়। সোমবার সন্ধ্যার পর বৃষ্টিপাত বন্ধ হলেও মঙ্গলবার সকাল থেকে আবারো থেমে থেমে চলছে, যা বুধবারও অব্যাহত আছে, তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। রবিবার থেকে টানা বৃষ্টির সঙ্গে অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ার ও পাহাড়ি ঢল যুক্ত হয়ে বিভিন্ন উপজেলা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। দুইদিনের ব্যবধানে সেটা বন্যা পরিস্থিতিতে রূপ নেয়। বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় উপজেলায় নেমেছে সেনা ও নৌবাহিনী।
টানা ছয়দিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার গভীর রাতে বাঁশখালীর বৈলগাঁও ২ নম্বর ওয়ার্ডে ঘরের দেয়াল ধসে মারা যায় মেজবাহ নামে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু। সোমবার সন্ধ্যায় রাউজানের উরকিরচরে হালদা নদীর শাখা খালে পড়ে শাহেদ ইসলাম বাবু (৪০) নামে এক খামারির নিখোঁজের দুইদিন পর তার লাশ মিলেছে। একইদিন সকালে হাটহাজারী উপজেলার ইসলামীয়া হাট বাদামতল এলাকায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে পানিতে পড়ে মৃত্যু হয় নিপা পালিত নামে এক ছাত্রীর। তিনি হাটহাজারী সরকারি কলেজের বিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন।
সূত্রঃ ভোরের কাগজ
Aninda, Sub-Editor