নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারাখানায় আগুনের ঘটনায় দেড় শতাধিক মানুষ নিখোঁজ আছেন বলে জানা গেছে।
তবে তাঁদের কেউ কারখানার শ্রমিক নন বলে দাবি কারখানা কর্তৃপক্ষের। কারখানায় লুটপাট কিংবা অন্য কোনো কাজে তাঁরা এসেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানার সামনে সোমবার দুপুর থেকে নিখোঁজ মানুষের স্বজনেরা ভিড় জমাতে থাকেন। তখন ফায়ার সার্ভিস নিখোঁজের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। বেলা ৩টা পর্যন্ত ১৭৬ জনের নিখোঁজের তালিকা করে ফায়ার সার্ভিস।
জানা যায়, রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে স্থানীয়দের মাধ্যমে গাজী টায়ার কারাখানায় আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিস। ঢাকা ফুলবাড়িয়া ফায়ার স্টেশন, ডেমরা, কাঁচপুর, আদমজী ইপিজেড ও কাঞ্চন ফায়ার স্টেশন থেকে একে একে যোগ দেয় ১২টি ইউনিট। ভবনটির ভেতরে ১৭৬ জন আটকা পড়ে আছে বলে স্বজন ও এলাকাবাসী দাবি করেছেন। আটকা পড়াদের জন্য তাদের পরিবার-পরিজনের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে কারখানা এলাকা।
ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশও কাজ করছে। তবে ফায়ার সার্ভিস জানায়, এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস নিহতের তালিকা করছে বলে দু-একটি গণমাধ্যম তথ্য প্রকাশ করেছে। এটি সঠিক নয়। ফায়ার সার্ভিস নিহতের বা নিখোঁজের কোনো তালিকা করছে না। এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাদের ফোন নম্বর ফায়ার সার্ভিসকে দিয়ে কোনো ভিকটিম পাওয়া গেলে তাদের জানানোর অনুরোধ করেছেন মাত্র।
ঘটনাস্থলে কথা হয় শহীদুলের সঙ্গে তিনি জানান, তার ছোট ভাই স্বপন ইসলাম, ভাগিনা সাঈদুল ইসলাম নিখোঁজ। তারা গাজী টাওয়ারের তৃতীয় তলায় কাজ করত। রোববার রাত বারোটা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তারা বারবার বলছিল তাদের বাঁচাতে। রাতে তারা এখানে এলেও আগুনের তীব্রতায় ভেতরে ঢুকতে পারেনি। যদিও তখন শত শত মানুষ ছিল ফ্যাক্টরির সামনে।
নাতি নিরবকে (১৭) খুঁজতে এসেছিলেন সুরাইয়া। নাতির খোঁজে আহাজারি করছিলেন তিনি। তার নাতি কাজ করতো যাত্রামুড়া এলাকার নবীন কটন মিলে। যাত্রামুড়া গাজী টায়ার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। এত দূরে কেন এসেছিল তার নাতি ? সুরাইয়া জানান, মিল্লাত নামের তার আরেক বন্ধু তাকে ডেকে এনেছিল। মিল্লাত, নিরব দু’জনেই নিখোঁজ।
জ্বলন্ত ভবনে কারখানার সামনেই দুই বছরের ছেলে আদনানকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন গৃহবধূ মোসা. রুবি। তিনি জানান, তাঁর স্বামী মো. সজিব (২৬) গত রাত নয়টা থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। সজিব উপজেলার মুড়াপাড়া গঙ্গানগর এলাকার শহীদ মিয়ার ছেলে। সজিব রাজমিস্ত্রীর কাজ করত জানিয়ে রুবি বলেন, কারখানায় লুটপাট হচ্ছে শুনে সজিব কারখানায় আসে। রাত নয়টায় শেষবার কথা হয়। তখন সে কারখানায় ছিল। পরে আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
একই স্থানে বিলাপ করছিলেন রূপসী মইকূলি এলাকার মো. সজিব ভূঁইয়ার (৩২) স্ত্রী কল্পনা আক্তার। কল্পনা জানান, তার স্বামী একজন জামদানী ব্যবসায়ী। তাঁদের কারখানার শ্রমিক মো. সাদ্দাম কারখানা লুটপাটের সময় আসেন। তাঁর খোঁজে রাত ১০টায় কারখানায় আসেন সজিব। রাত সাড়ে দশটায় সজিব মায়ের মুঠোফোনে ফোন করে তাঁকে বাঁচানোর আকুতি জানান। তারপর আর সজিবের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
তাদের মতো আরও অন্তত একশ সত্তর জন নিখোঁজ বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জের উপ-সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন। এই ১৭০ জনের আত্মীয়রা তাদের স্বজন নিখোঁজ বলে ফায়ার সার্ভিসের কাছে নাম লিখিয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, সাবেক মন্ত্রী ও গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তারের পর থেকে কারখানাটিতে গণহারে লুটপাট চলে। আগুন লাগার সময়ও লুট করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন ভেতরে আটকা পড়েছেন বলে দাবি করেন।
ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক রেজাউল করিম (প্রশিক্ষণ) বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ করছে। অবকাঠামোগত ও ভেতরে থাকা টায়ার উৎপাদনের দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারটি জটিল হয়ে পড়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে কতক্ষণ লাগবে এটা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছুই ধারণা করা যাচ্ছে না। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলে কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
সূত্রঃ সমকাল