রাজধানীর শাহজাদপুর এলাকায় একটি ৬তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে চারজন নিহত ও দু’জন আহত হয়েছেন।
আগুনে ভবনের দ্বিতীয় তলার গোল্ডেন টিউলিপ বিউটি পার্লার পুরো ভস্মীভূত হয়ে গেলেও তৃতীয় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত সৌদিয়া আবাসিক হোটেলের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। নিহত চারজনই আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। কোনো ফায়ার সেফটি না থাকায় গত ৬/৭ মাস আগেও আগুন লেগেছিল সরু সিঁড়ির এই ভবনে।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, আগুন লাগা ছয়তলা ভবনটির নিচতলায় রুমা ডিজিটাল নামে একটি স্টুডিও রয়েছে। এ ছাড়া মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচার ও মুন্নি এন্টারপ্রাইজ নামে আরও দু’টি দোকান। আর দ্বিতীয় তলায় গোল্ডেন টিউলিপ নামে মেয়েদের একটি বিউটি পার্লার। তিনতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত সৌদিয়া আবাসিক হোটেল।
ষষ্ঠ তলার ছাদের অর্ধেক অংশেও হোটেলের কার্যক্রম চলে। আর বাকি অর্ধেক খোলা ছাদ। আগুনে ভবনের দ্বিতীয় তলার বিউটি পার্লার সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নিচতলার দোকানগুলোতেও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তৃতীয় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত হোটেলের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ভবনের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ভবনের ভেতরে বিভিন্ন ফ্লোরে কাঁচের ভাঙা টুকরো। ৪ তলার হোটেল রুমের সামনে একজনের লাশ ছিল। লাশটি মূলত হোটেলের একটি রুমের বাথরুম থেকে বের করা হয়। আর ষষ্ঠ তলার ছাদের তালাবদ্ধ দরজার সামনে আরও তিনটি লাশ পড়ে ছিল। তাদের মধ্যে মিরন জম্মাদার (৬০) নামে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। নিহত মিরন সোমবার সকালে তার বোনের স্বামী হিরন তালুকদারের সঙ্গে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন।
অশ্রুসিক্ত হয়ে নিহত মিরনের বোন জামাই হিরন তালুকদার বলেন, মিরনের ছেলে মুবিন জমাদ্দার মঙ্গলবার সন্ধ্যার একটি ফ্লাইটে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা রয়েছে। তাই মুবিন শাহজালাল বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি হোটেলে রুম নিয়েছেন। আর আমি ও মিরন সোমবার সকাল ৮টায়ই ওই সৌদিয়া আবাসিক হোটেলটির চারতলার ৪০২ নম্বর রুমে উঠি। হোটেলে রুম ঠিক করার পর হাত-মুখ ধুয়ে আমরা দু’জন নাস্তা করতে হোটেলের পাশের একটি রেস্টুরেন্টে যাই। আগে নাস্তা শেষ করে মিরন ভাই আমাকে বলেন, আপনি নাস্তা করে আসেন, আমি একটু বিশ্রাম নেই।
এর কিছুক্ষণ পরে আগুন দেখে হোটেলের নিচে দৌড়ে আসি। দেখি পুরো হোটেল আগুনে ধোঁয়াচ্ছন্ন। তখনই মিরন আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি বাঁচার কোনো পথ পাচ্ছি না। চারদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেভাবেই হোক আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো। আমাকে বাঁচাও। পরে আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ফায়ার সার্ভিস সেই চারতলা থেকেই মিরনের লাশ উদ্ধার করে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দা মুন্না রহমান, লিয়াকত হোসেন, লিপি আক্তারসহ বেশ কয়েকজন বলেন, আগুনের সূত্রপাত ঘটে দ্বিতীয় তলার বিউটি পার্লার থেকে। পরে বিউটি পার্লার থেকে আগুন বাড়তে থাকে আর প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়।
তারা বলেন, ভবনটির অবস্থা খুব খারাপ। এখানে এমন চিপা সিঁড়ি যে আগুন লাগলে কোনো মানুষ দৌড়ে বের হতে পারবে না। এরপর ছাদের দরজাতেও ছিল তালা মারা। যারা ভেতরে ছিল তারা প্রাণ বাঁচাতে ছাদে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় ধোঁয়াতেই মারা যান। ভবনটির নিচ তলার মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচারের মালিক ফারুক হোসেন বলেন, সোমবার বেলা ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে আগুন লাগে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ক্যাশ বক্স নিয়ে আমি বের হয়ে যাই। তিনি বলেন, মূলত দুই তলার বিউটি পার্লার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেখানে নাকি এসি থেকে প্রথম আগুন লাগে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভান। আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার পরিমাণ ছিল বেশি। তিনি বলেন, এর আগেও ৬/৭ মাস আগে এই একই ভবনে আগুন লেগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ঢাকা জোনের সহকারী পরিচালক কাজী নাজমুজ্জামান বলেন, সোমবার দুপুর ১২টা ১৭ মিনিটের দিকে আগুন লাগার সংবাদ পাই আমরা। ১২টা ৩১ মিনিটের দিকে বারিধারা ফায়ার স্টেশনের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরে তেজগাঁও ফায়ার সার্ভিসের আরও দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে যোগ দেয়। তাদের প্রায় আধা ঘণ্টার প্রচেষ্টায় দুপুর ১টা ৪ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তিনি বলেন, রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী বিল্ডিংটি তৈরি করা হয়নি।
ভবনটিতে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। সিঁড়িগুলো ছিল সরু। সিঁড়ির পাশে যে জানালা ছিল, সেগুলো কাঁচ দিয়ে বন্ধ করা। আর ভবনটির নিচতলায় হার্ডওয়্যারের দোকান, দ্বিতীয়তলায় বিউটি পার্লার, তৃতীয় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন। তাই দুই তলায় আগুন লাগার পর প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। কাঁচ দিয়ে বন্ধ করায় ধোঁয়া বাইরে বের হতে পারেনি। আর এই অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন, ভবনটিতে আগুন লাগার পর হোটেলে থাকা চারজন ভয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ছাদে থাকা চিলেকোঠার দরজাটি বন্ধ ছিল। ফলে তারা আর সেখান থেকে বের হতে পারেননি। তাই মনে হচ্ছে অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণেই তাদের চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে ঠিক কি কারণে এই আগুন লেগেছিল, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তদন্তের পরই এই অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে বলা যাবে। আগুন লাগার পর ভবনের মালিক বা কর্তৃপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি বলেও জানান ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।
ঘটনাস্থল থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, উদ্ধার করা লাশগুলো আগুনের তাপে কিছুটা পুড়ে গেছে। আমরা এখন পর্যন্ত একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। বাকি তিনজনের পরিচয় জানা যায়নি। আমরা ঘটনাস্থলে এসে বিউটি পার্লার এবং হোটেলের কাউকেই পাইনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তৃপক্ষ বা কর্মচারীকে পাওয়া যায়নি। এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্রঃ মানবজমিন