ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পেলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও গবেষক সালেক খোকন।
ব্র্যাক ব্যাংক ও সমকালের পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা পেলেন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এছাড়াও কথাসাহিত্যে মঞ্জু সরকার, তরুণ কথাসাহিত্যিক শাখায় পুরস্কৃত হয়েছেন কিযী তাহনিন।
শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বসে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০২১-এর আসর। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষক-সংস্কৃতিকর্মী, উদ্যোক্তা ও বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এ আয়োজন পরিণত হয় মিলনমেলায়।
মঞ্চে ছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর, সমকালের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ, ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন, জুরি বোর্ডের সদস্য ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন।
২০১০ সাল থেকে সাহিত্য পুরস্কার দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক ও সমকাল। তবে এবারের ১১তম আসরে প্রথম দেওয়া হয়েছে আজীবন সম্মাননা। দেশের জন্য নিরন্তর কাজ করে চলা বরেণ্য ব্যক্তিদের সম্মান জানাতেই পুরস্কার প্রদানের এ প্রয়াস বলে জানিয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশন ইকরাম কবীর। তথ্যচিত্রে সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, শুধু সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে উন্নয়নের সহযাত্রী নয়, সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও কাজ করছে সমকাল। সাহিত্য পুরস্কার সেই প্রয়াসের অংশ।
সাহিত্য ও গবেষণার তিনটি শাখায় পুরস্কারের জন্য ২০২১ সালে প্রকাশিত বই জমা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এরপর ৫৭০টি বই জমা পড়ে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, কবি আবিদ আনোয়ার, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস এবং লেখক ও গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত জুরি বোর্ড শ্রেষ্ঠ বিবেচনায় তিনটি বই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করে।
কবিতা ও কথাসাহিত্য শাখায় নির্বাচিত হয় কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের উপন্যাস ‘উজানযাত্রা’। বইটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। প্রবন্ধ, গবেষণা, অনুবাদ, ভ্রমণ ও আত্মজীবনী শাখায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছে সালেক খোকনের গবেষণাগ্রন্থ ‘৭১-এর আকরগ্রন্থ’। বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। তাঁদের উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানানো হয় এবং দুই লাখ টাকার চেক, পদক ও সনদ তুলে দেন অতিথিরা। কিযী তাহনিনের লেখা ‘বুধগ্রহে চাঁদ উঠেছে’ গল্পগ্রন্থ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার পেয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য এক লাখ টাকা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান এবং ৬৫ বছরের বেশি সময় ধরে লেখালেখি ও গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে দেশসেবায় অবদান রাখা রেহমান সোবহান সম্মাননার অর্থমূল্য পাঁচ লাখ টাকা দান করেছেন প্রতীচী ট্রাস্টকে। তাঁর হাতে পদক তুলে দেন শিরীন শারমিন চৌধুরী।
৮৭ বছর বয়সী রেহমান সোবহান দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন; ধীরে তবে দৃঢ়কণ্ঠে বলেন সাত দশকের অর্থনীতির গল্প। তিনি বলেন, কোনো গবেষণা ও লেখার কাজ এককভাবে করিনি। সহকর্মীদেরও অবদান রয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফায় অর্থনৈতিক দাবি তুলে ধরার নেপথ্যে কাজ করেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে আসা রেহমান সোবহান। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করে। রেহমান সোবহান বলেছেন, বাংলাদেশ অনেক উন্নয়ন করেছে। কিন্তু রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার মতোই, প্রান্তিক মানুষের কাছে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দেওয়ার ‘প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আরও বহু পথ যেতে হবে’। উন্নয়ন হয়েছে। যেমন- পোশাকশিল্প ভালো করছে। উদ্যোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন। কিন্তু যে লাখো নারী কর্মী এই খাতকে এগিয়ে নিয়েছে, তাদের কি একই রকম উন্নতি হয়েছে? অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহানের স্মৃতিময় পরিচিতি তুলে ধরেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুজ্জামান।
যোগ্য সাহিত্যিককে পুরস্কৃত না করার ‘রীতি’কে কটাক্ষ করে পুরস্কারজয়ী মঞ্জু সরকার বলেন, ‘পাঁচতারকা হোটেলের অনুষ্ঠানে কখনও আসিনি।’ তিনি জানান, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকালের পুরস্কারের জন্য বই জমা দেননি। পুরস্কার পেতে চেষ্টাও করেননি। সেই ক্ষমতা ও যোগ্যতা তাঁর নেই। তারপরও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে বাংলা একাডেমির পর প্রথম পুরস্কার পেলেন তিনি।
১১ বছরের গবেষণায় লেখা বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তিক মানুষের গৌরবগাথা তুলে ধরেছেন সালেক খোকন। পুরস্কারজয়ী এই গবেষক বলেছেন, ১১১ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ জয়ের গল্প, বীরত্ব, তাঁদের আনন্দ-বেদনা ও স্বপ্নভঙ্গের কথা রয়েছে এ বইয়ে।
তাঁর মতো একজন তরুণ লেখককে পুরস্কৃত করায় উচ্ছ্বসিত কিযী তাহনিন। তিনি বলেছেন, নিজেকে ভেঙেছেন, আবার গড়েছেন ‘বুধগ্রহে চাঁদ উঠেছে’ গল্পে। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল পুরস্কার এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রেরণা হবে।
‘জনগণই সাহিত্য ও শিল্পে উৎস’- বঙ্গবন্ধুর উদ্বৃতি দিয়ে স্পিকার বলেছেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিশ্বদরবারে উজ্জ্বলতর করে প্রকাশ করতে সৃজনশীল সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনকাহিনি সাহিত্যে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের নারীরা সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন, তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন- এগুলো আশাব্যঞ্জক।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ও সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের কথা স্মরণ করে এ. কে. আজাদ বলেন, তাঁরা সাহিত্য পুরস্কার অনুষ্ঠানের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতেন। আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত রেহমান সোবহানসহ পুরস্কার বিজয়ীদের সাফল্য কামনা করেন এ. কে. আজাদ।
শিল্প-সাহিত্যের চর্চা রাজধানীকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় আক্ষেপ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্রামীণ সংস্কৃতি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা যত কমবে, জাতির মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি তত প্রকট হবে। আমরা গ্রাম থেকে লালনকে ঢাকায় এনেছি। এখন সময় এসেছে তাঁকে আবার সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার।
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন সেলিম আর এফ হোসেন। তিনি বলেন, ৫৭০টি বই থেকে তিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এই তিনটি বই সাহিত্যের মানে অনেক ওপরে। তিনি শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলায় জোর দেন।
মোজাম্মেল হোসেন আশা প্রকাশ করেছেন, বিজয়ীরা আরও মহৎ সাহিত্য সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করবেন। তিনি বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায় সাহিত্য পুরস্কার দিচ্ছে সমকাল। আগামীতেও প্রতিষ্ঠানটি পাশে থাকবে বলে আশাবাদী সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।
অনুষ্ঠানে স্পিকারকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন এ. কে. আজাদ। পূজা সেনগুপ্তের ভাবনা ও নির্দেশনায় নৃত্য পরিবেশনায় শুরু হয় অনুষ্ঠান। এর পর বরেণ্য লালনশিল্পী ফরিদা পারভীন গানে মুগ্ধ করেন সমবেতদের। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, হাসনাত আবদুল হাই, ফারুক মাহমুদ, বিমল গুহ, কামরুল আহসান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, দিলওয়ার হাসান, আমিনুল ইসলাম, আফসানা বেগম, টোকন ঠাকুর, হোসেন আবদুল মান্নান, মনিকা চক্রবর্তী, আলফ্রেড খোকনসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক ছিলেন দর্শক সারিতে।
উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার এমপি, গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ চৌধুরী, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আবুল খায়ের লিটু, প্রকাশক আবুল কালাম আজাদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি প্রমুখ। ছিলেন উপদেষ্টা সম্পাদক আলমগীর হোসেনসহ সমকালের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা।
সূত্রঃ সমকাল
Aninda, Sub-Editor