বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আর ভোগান্তি যেন চট্টগ্রামবাসীর নিত্যদিনের ঘটনা। সামান্য বৃষ্টিতে সড়ক ছাপিয়ে ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় পানি। গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে ডুবেছে চট্টগ্রাম নগরের অনেক এলাকা। একদিকে জলাবদ্ধতায় যেমন জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে অনবরত বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের শঙ্কা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গত শুক্রবার বন্ধের দিন থাকায় খুব বেশি ভোগান্তি না হলেও গতকাল শনিবার দিনভর জলাবদ্ধতার কারণে নানামুখী দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে। এমনকি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিমকে বাসায় ঢুকতে হয়েছে রিকশায় চড়ে।

গতকাল দুপুরে রিকশায় করে নিজ বাড়িতে প্রবেশ করেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম। এ সময়কার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা গেছে রিকশায় করে হাঁটুপানি পার হয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকছেন মেয়র রেজাউল। মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী মোস্তফা জামাল চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘মেয়র আজ (গতকাল) অফিস করতে বের হয়েছেন। তিনি গাড়িতে চড়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন; গাড়িতে করেই ফিরেছেন।’

মেয়রের মতো চলাচলের পথে কাল দিনভর ভোগান্তিতে ছিলেন নগরবাসীও। মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, চকবাজার কর্নেলহাট, আগ্রাবাদসহ বেশিরভাগ এলাকায় ছিল কোমর থেকে হাঁটুপানি। এর ফলে অফিসমুখী মানুষজন ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন। অনেককেই রাস্তার মাঝখানের সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে চলাচল করতে দেখা যায়।

সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি দাশ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চট্টগ্রামের আমবাগান আবহাওয়া কেন্দ্রে ৮৬ মিলিমিটার ও পতেঙ্গা কেন্দ্রে ৬৬ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মধ্যরাত থেকে আবার ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আজ রবিবার দিনভর ভারী বর্ষণ থাকবে।

নাকাল চট্টগ্রাম

এর ফলে পাহাড় ধসের ঝুঁকিও দেখা দিয়েছে। শুক্রবার সকালে টাইগারপাস এলাকায় ছোট আকারে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলেও গত দুই দিনে বড় কোনো পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেনি। তবে ছোট ছোট আকারে বেলতলীঘোনা এলাকায় কিছু পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। বেলতলীঘোনার স্থানীয় বাসিন্দা পান্না বেগম বলেন, এখানে চসিকের তিনটা ময়লার গাড়ি ছিল। সেগুলোর ওপর পাহাড় থেকে মাটি পড়েছে। এমনিতে কোনো হতাহত হয়নি।

আকবর শাহ এলাকার বেলতলীঘোনা, বিজয়নগর, ঝিল এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার জন্য দিনভর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি। আকবর শাহর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ওমর ফারুক বলেন, ‘১৯টা আশ্রায়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে আমরা টিম নিয়ে পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করব।’

এ ছাড়া টানা বর্ষণে কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত ব্যক্তিদের আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে প্রতিদিনই সচেতন করা হচ্ছে। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারী ব্যক্তিদের সরিয়ে নিতে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৫৫ জন অবস্থান করছেন। এ ছাড়া বাকিদের আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসতে প্রচারণা অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মহিউদ্দিন বলেন, ইতোমধ্যে কাপ্তাই উপজেলায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত ব্যক্তিদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসতে উপজেলা প্রশাসন ও কাপ্তাই তথ্য অফিস প্রতিনিয়ত প্রচারণা ও মাইকিং চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কাপ্তাইয়ের নতুন বাজারসংলগ্ন ঢাকাইয়া কলোনি এবং আফসার টিলা নামক এই এলাকাগুলো পাহাড় ধসের বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় ৫৫ জন গত শুক্রবার থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের খাবার বিতরণও করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ইউনিয়নেও আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে বলেও তিনি জানান।

রাউজানে টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল, হালদা ও কর্ণফুলি নদীর প্রবল স্রোতে পানির নিচে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, সড়ক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন এলাকা। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন আমনচাষিরাও। অলিগলিতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতার। বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন হালদা ও কর্ণফুলিপাড়ের এলাকাগুলো। হালদাপাড়ের উরকিরচর, পশ্চিম গুজরা, নোয়াপাড়া, কর্ণফুলি এলাকার কচুখাইন, বাগোয়ানের বিভিন্ন এলাকার রাস্তা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে। অন্যদিকে কদলপুর, পৌরসভার কিছু কিছু অংশ, গহিরার বেশ কিছু এলাকায় সড়ক, ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। জমিতে কোমরপানি হওয়ায় অনেক চাষির আমন আবাদের কাজ স্থগিত রয়েছে। কৃষক ফজলুল কাদের বলেন, ‘এতদিন বৃষ্টির অভাবে চাষ করতে পারিনি, এখন পারছি না বেশি বৃষ্টির কারণে। পানি কমলে আবার কাজে নামব।’

এ বিষয়ে রাউজান উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নিয়াজ মোরশেদ বলেন, ‘বেশ কিছু এলাকায় বর্ষণ ও নদীর পানিতে ক্ষতিগ্রস্তের কথা শুনেছি। এতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ক্ষতির তালিকা দিতে বলা হয়েছে। এটি হাতে এলে বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সূত্রঃ প্রতিদিনের বাংলাদেশ