চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবরশাহ থানার ফয়’স লেক এলাকায় বেড়াতে গিয়ে আনসার সদস্যদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজিম উদ্দিন। এ সময় নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে সপরিবারে ছিলেন বান্দরবান সদর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম।
ঘটনার পরপরই আকবর শাহ থানার ওসি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মারধরের ঘটনায় জড়িত আনসার সদস্য সোহেল রানা ও মোহাম্মদ মুহিন আহমেদকে থানা হেফাজতে নেন। পরে মধ্যরাতে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থানায় বৈঠকে মিলিত হন। শেষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার শর্তে হেফাজতে থাকা দুই আনসার সদস্যকে বাহিনীর পরিচালকের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
আনসার সদস্যদের হাতে পুলিশ পরিদর্শক লাঞ্ছিত হওয়ার পরও মামলা না করে সাধারণ ডায়েরিভুক্ত করা এবং হেফাজতে নেওয়া দুই আনসার সদস্যকে জিম্মায় দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন পুলিশ কনস্টেবলবরা। তবে ভবিষ্যতে বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হতে পারে, এমন আশঙ্কায় বিক্ষুব্ধ কনস্টেবলরা নিজদের পরিচয় প্রকাশ করে বক্তব্য দেননি।
নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে একাধিক কনস্টেবল জানিয়েছেন, আনসার বাহিনীর সদস্যরা চরম ন্যক্কারজনক আচরণ করেছে। পুলিশ বাহিনীর একজন পরিদর্শকের পরিচয় পাওয়ার পরও মারধর করেছে, এটা মেনে নেওয়া কষ্টের।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ এবং আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্যদের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) বিকালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি নাজিম উদ্দিন ও বান্দরবান সদর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম সপরিবারে ফয়’স অ্যামিউজমেন্ট পার্কে প্রবেশের লক্ষ্যে ওই এলাকায় যান। তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি ফয়’স লেকের আনসার ব্যাটালিয়ন রেঞ্জ অফিসের প্রধান ফটক অতিক্রম করার পর থামে।
এ সময় গাড়ি পার্কিং করাকে কেন্দ্র করে আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্য সোহেল রানার সঙ্গে রেলওয়ে থানার ওসি নাজিম উদ্দিনের তর্ক হয়। তর্কের একপর্যায়ে সোহেল রানা ও মোহাম্মদ মুহিন আহমেদসহ কয়েকজন মিলে পুলিশ পরিদর্শক নাজিম উদ্দিনকে ব্যাটালিয়নের গেটের ভেতরে নিয়ে মারধর করেন।
নাজিম উদ্দিনকে মারধরের ঘটনার তথ্য জেনে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছেন আকবর শাহ থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর। তিনি ঘটনাস্থল থেকে আনসার সদস্য সোহেল ও মুহিনকে হেফাজতে নেন। এই ঘটনার পর রাতেই আকবর শাহ থানায় পৌঁছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) জসিম উদ্দিন ও রেলওয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশের সুপার প্রকৌশলী হাসান চৌধুরী। এরপর থানায় যান ৩১ আনসার ব্যাটালিয়ন ফয়’স লেকের পরিচালক নাজমুল হক নুরনবী।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, রেলওয়ে থানার ওসি নাজিম উদ্দিনকে মারধরের ঘটনায় থানায় নিয়মিত মামলা রুজু হবে না। দুই বাহিনীর মধ্যে ভবিষ্যতে সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে মারধরের ঘটনায় মামলা রুজু না করা এবং ওসিকে মারধরের ঘটনায় জড়িত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এই সিদ্ধান্তের পর পুলিশ হেফাজতে থাকা দুই আনসার সদস্যকে রাত সাড়ে ১১টায় আনসার বাহিনীর পরিচালকের জিম্মায় ছেড়ে দেয় পুলিশ। শেষে আকবর শাহ থানা পুলিশ নিয়মিত মামলা রুজুর পরিবর্তে একটি সাধারণ ডায়েরি (১৫০৫, তারিখ : ২৭.১২.২০২২) লিপিবদ্ধ করে।
তবে আনসার সদস্যের হাতে পুলিশ পরিদর্শক লাঞ্ছিত হওয়া ঘটনায় জড়িতদের ছেড়ে দেওয়ায় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ ও রেলওয়ে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পরিচয় প্রকাশ হবে না শর্তে একাধিক পুলিশ কনস্টেবল জানিয়েছেন, বাহিনীর কর্মকর্তার পরিচয় জানার পর কেমন আচরণ করা হবে, সেটা প্রশিক্ষণকালেই শেখানো হয় বাহিনীর কনস্টেবল-সৈনিকদের। এক্ষেত্রে পুলিশ পরিদর্শক পরিচয় দেওয়ার পরও আনসার সদস্যরা চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ ও মারধরের মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজু না করায় পুলিশ বাহিনীর সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে।
মারধরের শিকার হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে থানার ওসি মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর এখন ছুটিতে আছি। মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। তাই এই বিষয়ে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’
একই বিষয়ে জানতে বান্দরবান সদর থানার ওসি শহিদুল ইসলামকে ফোন করা হলেও তিনি অপর প্রান্ত থেকে সাড়া দেননি।
আকবর শাহ থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর বলেন, ‘ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজন আনসার সদস্যকে হেফাজতে নিই। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে তাদের আনসার বাহিনীর পরিচালকের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় কেউ অভিযোগ দাখিল করেননি। ফলে মামলা রুজু হয়নি।’
একই বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দুই বাহিনীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আলোচনার পর এটি মীমাংসা করা হয়েছে। আনসার বাহিনী এরই মধ্যে জড়িত সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে পুলিশকে অবহিত করেছে।’
জড়িত আনসার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে ৩১ আনসার ব্যাটালিয়ন ফয়’স লেকের পরিচালক নাজমুল হক নূরনবী বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের পর জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আনসার বাহিনীর সদস্যরা অন্য বাহিনীর সদস্যদের পরিচয় পাওয়ার পর কী ধরনের আচরণ করবেন, সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব বাহিনীর সৈনিকদের প্রশিক্ষণের সময়ই আচরণগত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আনসার সদস্যদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’
সূত্রঃ প্রতিদিনের বাংলাদেশ
Aninda, Sub-Editor