জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতদের বিনামূল্যে আজীবন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ইউনিক আইডি কার্ড দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী দায়িত্ব পাওয়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এছাড়া আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে লিখিত রূপরেখা দেওয়া হবে। রূপরেখায় দেওয়া টাইমলাইন অনুযায়ী সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আহতদের সঙ্গে ছয় উপদেষ্টার বৈঠক শেষে এসব কথা জানান তিনি। অন্তত ৮০ জন আহতের সঙ্গে বিকেল সাড়ে ৪টায় শুরু হয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলা এ বৈঠক।

এ সময় ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বৈঠকে অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম, আন্দোলনে শহীদ মুগ্ধর জমজ ভাই ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ।

বৈঠক শেষে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, আহত যোদ্ধাদের ইউনিক আইডি কার্ড থাকবে। সব সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তারা সারা জীবন বিনামূল্যে সেবা পাবেন। যেসব বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারি চুক্তি থাকবে সেখানেও বিনামূল্যে সেবা পাবেন তারা। ১৭ নভেম্বরের পর সাপোর্ট সেন্টার থাকবে। সেখান থেকে সব ধরনের সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। আহতদের চিকিৎসায় সব সরকারি হাসপাতালে বেড ডেডিকেটেড থাকবে। ঢাকার সব হাসপাতালকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এ বিষয়ে গাফিলতি কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।

বৈঠকে যে যা বললেন

বৈঠক সূত্র জানায়, শুরুতে সার্জিস আলম সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আহতদের দাবি-দাওয়া ও সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেন। পরে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় অনেকগুলো বিষয় রয়েছে, যেমন আইনি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন যা হয়েছে, নানা অভিযোগ উঠেছে, আমরা তা জানি। তবে এখন থেকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান দায়িত্ব নিয়েছেন, তিনি শুধু আন্দোলনে আহতদের বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য কাজ তিনি করবেন না।

পরক্ষণেই ডা. সায়েদুর দাঁড়িয়ে রক্তিম অভিবাদন জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, আমৃত্যু চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে সরকার। ইউনিক কার্ড হবে, সবাই এটি দেখিয়ে সারা জীবন সরকারি সব হাসপাতালে এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ সব হাসপাতালে দেখিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবেন। কোথাও লাইনে দাঁড়াতে হলে এই কার্ডধারীরা অগ্রাধিকার পাবেন। এ সময় আহতরা হাততালি দিয়ে তার বক্তব্যকে স্বাগত জানান।

ডা. সায়েদুর আরও বলেন, সব সরকারি হাসপাতালে ফাস্ট ট্র্যাক সার্ভিস চালু হবে। হাসপাতালে কতটা শয্যা খালি আছে কতটায় রোগী আছে তার একটি ড্যাশবোর্ড চালু করা হবে। যে কেউ তা দেখতে পাবেন। ঢাকার হাসপাতালগুলো একটা ড্যাশবোর্ডে থাকবে। এটি ওয়েবসাইটে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হবে।

তিনি বলেন, আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় সরকারের পক্ষ থেকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে অর্থাৎ আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে লিখিত রূপরেখা প্রকাশ করা হবে। ১৭ নভেম্বর সাপোর্ট সেন্টার চালু হবে। যে কেউ ফোন করে এ সংক্রান্ত তথ্য নিতে পারবেন এবং অভিযোগ জানাতে পারবেন। ডিসেম্বরের মধ্যে সবগুলো উদ্যোগ দৃশ্যমান অগ্রগতি পাবেন। আর ডিসেম্বরের মধ্যে সব দফা বাস্তবায়নের কাজ চলমান হবে।

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা এবং অর্থ প্রদানে কোথাও কোনো গাফিলতির অভিযোগ হলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো গাফিলতি বরদাশত করা হবে না।

আন্দোলনে আহতদের কাজ করা সংগঠন রক্তিম জুলাই ২৪ এর আহ্বায়ক সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ নিজের চিকিৎসায় চার ঘণ্টা অনর্থক হাসপাতালে অপেক্ষার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমরা আশ্বাস আগেও পেয়েছি, আজ লিখিত নিতে এসেছি। উপদেষ্টা নাহিদ ভাইয়ের বাসায়ও আমরা গিয়েছি এ বিষয়ে কথা বলতে। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে দেখবেন বলেছেন। আমরা আহতরা আওয়ামী লীগের ট্রামকার্ডে পরিণত হচ্ছি এরই মধ্যে। আমরা এটি হতে দেব না।

আহতদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা পরিষদের কাউকে রাখার দাবি জানিয়ে এমদাদ বলেন, ৭ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি রক্ষায় পোস্ট দেওয়া ব্যক্তিকে উপদেষ্টা বানানো হচ্ছে। অথচ আহতরা রাষ্ট্র সংস্কারে অবদান রাখতে পারছে না। আমাদের ভাইয়েরা বিনা চিকিৎসায় মরতে বসছে, অনেকে অপচিকিৎসায় বা অবহেলায় চরম বিপদে পড়ছে। পা কাটার দরকার ছিল না তামিমের। কিন্তু তার পা কাটা হয়েছে।

অপর এক আহত তরুণ হাসপাতালের খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলেন, রাজশাহী থেকে এসে আমি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে ফাইল জমা দিতে পারছি না, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছি।

এ সময় ডা. সায়েদুর জানান, পিজি হাসপাতালসংলগ্ন পরীবাগে একটি ১০তলা ভবন ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেখানে আহতরা অবস্থান করতে পারবেন।

আহতদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা করার দাবি

পুরো বৈঠকে থেকে অন্তত দুবার আহতদের মধ্য থেকে একজনকে উপদেষ্টা অথবা সহ-উপদেষ্টা করার দাবি ওঠে। তবে উপদেষ্টারা এ নিয়ে কিছু বলেননি। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক আহত তরুণ স্বাস্থ্য উপদেষ্টার অপসারণ দাবি করলেও বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনা হয়নি।

পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা বলছি না যে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে। তিনি ব্যাংক খাতের যোগ্য মানুষ। তাকে অন্যত্র ভালো পদে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। ডা. সায়েদুর রহমানকেই স্বাস্থ্য উপদেষ্টা করা উচিত।’

জুলাই আন্দোলনে এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানো খুলনার আব্দুল্লাহ আল শাফিল সমকালকে বলেন, ‘আজ যেগুলো শুনলাম এগুলো খুবই ভালো উদ্যোগ, কিন্তু সরকারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এত প্রকট যে, দিনশেষে কাজটা হয়ে ওঠে না। কিছু উপদেষ্টার মনোভাবের পরিবর্তন জরুরি। স্বাস্থ্য, কৃষি ও কূটনীতিসহ কয়েকটি বিষয় বেশ উপেক্ষিত।’

শাফিল বলেন, আহতরা যে এতটা আর্তনাদ করে বেড়াচ্ছেন, এর জন্য স্বাস্থ্য উপকমিটি সবচেয়ে বেশি দায়ী। আমার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাড়ে তিন মাস হলো। উপকমিটি আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছে আমি সেগুলো বলতে চাই না। উপকমিটি অনেক ক্ষেত্রে ভাইরালের পেছনে ছুটেছে। তালিকাও ঠিক মতো করতে পারেনি। ১০ দিন পর তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। বলা হলো সিএমএইচ বা বারডেম এমন বড় হাসপাতাল থেকে বিদেশে পাঠাতে বললে তাদের পাঠানো হবে। আমাকে সিএমএইচ রেফার করল। কিন্তু উপকমিটি আমার বিষয়ে কোনো কিছুই করল না।

চিকিৎসা খরচ সামলাতে হিমশিম, খোঁজ নিচ্ছে না সরকার

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল)। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৮৩ জন। আহত ও তাদের পরিবারের দাবি প্রধান দাবি তিনটি- সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও অর্থ সহায়তা। তবে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, এদের মধ্যে সরকারি সহায়তা পেয়েছেন ৭১ জন। কাগজপত্র জটিলতায় বাকিদের টাকা পেতে দেরি হচ্ছে। এই কাজের গতি আনতে কাজ চলছে।

আহতদের প্রধান অভিযোগ, তারা তিন মাস ধরে হাসপাতালে থাকলেও সরকার তাদের খোঁজ নেয়নি। সেইসঙ্গে আর্থিক সহায়তা হিসাবে যে এক লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তা-ও তারা পাননি। হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হলেও আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, খাওয়াতে অনেক খরচ করতে হয় রোগীর পরিবারকে। অনেকেই বলেছেন, তাদের পরিবার সেই খরচের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কেন বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না, এই প্রশ্নের উত্তরও খোঁজ করেছেন তারা।

আজ সরেজমিন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পূর্নবাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) তৃতীয় তলায় ঢুকতেই হাতের ডান পাশের শয্যা চিকিৎসাধীন শিশু রবিউল ইসলামের (১১) দেখা মেলে। কাছে গেলে উঠে বসে রবিউল বলেন, গত ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর ২ এলাকা থেকে সে বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত পুঙ্গ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এরই মধ্যে তার পায়ে তিনটা অস্ত্রোপচার হয়েছে। গত বুধবার রাতেও একটি অস্ত্রোপচার করা হয়। চিকিৎসক পরিষ্কার কিছু বলছেন না। আমার পা বাঁচনো যাবে কি-না। তবে চিকিৎসা নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। তবে সরকারি অনুদানের টাকা পেতে দেরি হচ্ছে। রবিউলের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত পরিবার।

রবিউল ইসলামে মা শিউলি আক্তার বলেন, আমাদের আশা ছিল স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আমাদের পাশে বসবে, আমাদের দুঃখের কথাগুলো শুনবে। সুযোগ সুবিধাগুলো বুঝিয়ে দেবে। কোনো কিছুই হচ্ছে না।

চিকিৎসাধীন আন্দোলনে আহত সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ বলেন, তিন মাস পর শোনা লাগছে এক জন ভাইয়ের হাত কেটে ফেলতে হবে। তাহলে কী চিকিৎসা এতদিন হয়েছে। আহতদের জন্য রক্ত কিনতে হয় নিজের টাকা দিয়ে। দেরিতে চিকিৎসা দেওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। কিছু আহতদের বিদেশি নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। তবে বাস্তবে অগ্রগতি নেই।

পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজজামান সমকালকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন। কারও দুই বছর থেকে তিন বছর চিকিৎসা দিতে হবে। দীর্ঘদিন হাসপাতাল থাকতে থাকতে তাদের কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই হাসপাতালে বিদেশ থেকে তিনটি বিশেষজ্ঞ টিম এসে দেখে গেছে। তারা কোনো রোগীকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ দেননি।

বুধবার উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতদের একাংশ। মাঝরাতেও তাদের বিক্ষোভ অবস্থান অব্যাহত থাকে। পরে রাত আড়াইটার দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা সেখানে উপস্থিত হয়ে দাবি মানার এবং আহতদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গতকাল দুপুরে বৈঠকের আশ্বাস দিলে হাসপাতালে ফিরে যেতে রাজি হন বিক্ষোভকারীরা।

সূত্রঃ সমকাল