Home আন্তর্জাতিক গাজার গণহত্যা: মুসলিম বিশ্ব কেন নীরব?

গাজার গণহত্যা: মুসলিম বিশ্ব কেন নীরব?

8
0
গাজার গণহত্যা: মুসলিম বিশ্ব

গাজার আকাশে প্রতিদিন বোমার শব্দ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে হাসপাতাল, স্কুল ও মসজিদ, আর হাজারো নিরীহ মুসলিমের প্রাণ হারাচ্ছে। এ মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে বিশ্বমঞ্চে যেখানে প্রতিবাদের শব্দ তালে তালে উঠছে, সেখানে মুসলিম দেশগুলোর নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ।

কেন এই দেশগুলো, যারা ইসলামী ঐক্যের দাবি করে, গাজার গণহত্যা নিয়ে স্পষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ?

১. কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের চাপ

অনেক মুসলিম দেশ ইসরাইলের সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখে। বিশেষ করে, গত দশকের মধ্যে ‘আব্রাহাম একর্ড’-এর মত উদ্যোগের ফলে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সুদানসহ কিছু দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক দেশই গাজার ইস্যুতে সরাসরি ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে নরম ভাষায় সীমিত মন্তব্য বা চুপ থাকার পথ বেছে নিচ্ছে।

২. অর্থনৈতিক স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

কূটনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বার্থও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইসরাইলি প্রযুক্তি, পর্যটন, এবং অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা মুসলিম দেশগুলোর জন্য লাভজনক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা, অর্থনৈতিক সঞ্চালন এবং বাণিজ্যিক বিনিময়ে এই সম্পর্কগুলো বজায় রাখা দেশগুলোর জন্য অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। ফলে, গাজার গণহত্যার মত বিষয়গুলোতে সরাসরি মুখ খুলে বিরোধিতা করার পরিবর্তে নীরবতা বা মৃদু পর্যবেক্ষণ রাখা হচ্ছে।

৩. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

বহু মুসলিম দেশ অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক নীতি ও কূটনীতির দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ছে। দেশে-বিদেশে নানা সমস্যা মোকাবেলার প্রেক্ষাপটে, গাজার গণহত্যার বিষয়টি কখনো কখনো অগ্রাধিকার হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি, কিছু নেতৃবৃন্দ গণ্য করেন যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিলতায় সরাসরি বিরোধিতা করলে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

৪. ইসলামিক জাগরণ ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাব

যদিও মুসলিম নেতারা প্রায়ই ইসলামিক ঐক্য ও উম্মাহর স্বার্থের কথা বললেও, বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তারা কার্যকর আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহে ব্যর্থ হন। গাজার গণহত্যার সময় এ ধরনের সমর্থন পেতে হলে, ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে থাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্পষ্ট ও সুসংগঠিত নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে, বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন কূটনৈতিক আগ্রহ ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে এ ধরনের সমন্বয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

গাজার গণহত্যা: মুসলিম বিশ্ব
ছবি: সিএনএন

৫. সামাজিক ও জনমতের প্রতিক্রিয়া

সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন ফোরামে মুসলিম জনগণের ক্রোধ স্পষ্ট। জনগণ অভিযোগ করছে, “যেখানে নিরীহ শিশু, নারী এবং বৃদ্ধ নিহত হচ্ছে, সেখানে আমাদের নেতারা কেন মুখ বন্ধ?” এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে অনেকেই কূটনৈতিক স্বার্থের প্রাধান্যকে তুলে ধরছেন। তাদের মতে, যদি মানবতার মূল্যবোধ ও নৈতিকতার কথা গুরুত্বসহকারে নেওয়া হত, তাহলে গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে সঙ্গত প্রতিবাদ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেত।

৬. বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংস্থার মতামত

মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, গাজার এই গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। তারা যুক্তি দেন, “যদি মুসলিম দেশগুলো কূটনৈতিক স্বার্থের কারণে নীরব থাকে, তবে তা শুধু গাজার জন্য নয়, ভবিষ্যতে অন্যান্য মানবিক সংকটের মোকাবিলাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।” এই মতামতগুলো নির্দেশ করে, কূটনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক সুবিধার খাতে মানবাধিকারের মূল্যবোধ কখনো কখনো প্রথামান্যতা হারিয়ে যায়।

৭. উপসংহার

গাজার গণহত্যা শুধু একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়, এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রশ্নও। মুসলিম দেশগুলো যদি সত্যিকারের ইসলামিক ঐক্য ও ন্যায়বিচারের দাবি করেন, তবে তাদের উচিত কূটনৈতিক স্বার্থের বাইরে থেকে মানবিক দায়িত্ব পালন করা। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের নীরবতা শুধু তাদের নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করে না, বরং গাজার নিরীহ মানুষের প্রতি অবিচারের বন্ধন আরও শক্তিশালী করে। ইতিহাস হয়তো এ নীরবতাকে ক্ষমা করবে না; বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রজন্ম কি এই নীরবতার মূল্য পরিশোধ করবে তা সময়ই দেখাবে।

— নিউজ ডেস্ক