সুন্দরবনে আগুন: ১৫টি সুপারিশের ১৪টিই বাস্তবায়ন হয়নি
১৫ সুপারিশ। একটি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ১৪টি বাস্তবায়ন হয়নি। গত বছর সুন্দরবনে আগুন লাগার পর সুপারিশগুলো করেছিল তদন্ত কমিটি।
উদ্দেশ্য ছিল নতুন করে যাতে আগুন না লাগে। বছর না ঘুরতে আবার গত শনিবার ও রোববার আগুন লেগেছে বনে। এর পেছনে বর্ষাকালে মাছ ধরার জন্য শুষ্ক মৌসুমে আগুন দেওয়ার একটি চক্রের কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গত রোববার শাপলার বিল তেইশের ছিলা এলাকায় আগুন লাগে। ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এটা নেভানো যায়নি। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা বিপুলেশ্বর দাস বলেন, বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস ফায়ার লাইন কেটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা (এসিএফ) দীপন চন্দ্র দাস বলেন, তেইশের ছিলায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন যাতে আরও না ছড়ায় সেজন্য চারপাশে ফায়ার লাইন কাটা হয়েছে। কাছাকাছি কোনো পানির উৎস নেই। ঘটনাস্থল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ভোলা নদী। নদীতে জোয়ার ছাড়া পানি থাকে না। রোববার রাতে জোয়ারে ফায়ার সার্ভিস ও বনরক্ষীরা পাম্পের সাহায্যে পানি দিয়ে ছিটিয়েছেন। ভাটার সময় পানি দেওয়া বন্ধ থাকে।
শরণখোলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবতাদ ই আলম বলেন, বনের এক বর্গকিলোমিটারজুড়ে আগুন জ্বলছে। বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে আগুন ও ধোঁয়া দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিসের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, কচুয়া ও ফকিরহাট ইউনিটের অর্ধশত কর্মী আগুন নেভানোর কাজ করছেন।
মাছের লোভে বনে আগুন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরবনসংলগ্ন উত্তর রাজাপুর, পশ্চিম রাজাপুর, ধানসাগর, গুলিশাখালী ও আমুরবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, একটি চক্র বর্ষা মৌসুমে সুন্দরবনের বিলে মাছ ধরার জন্য শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগিয়ে ছাই তৈরি করে। বর্ষায় বিলে ছাই খেতে আসে কৈ, মাগুর ও শিং মাছ। বনরক্ষীদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে বিলে মাছ ধরে বাজারে বেচে চক্রের লোকজন। গোপন ও সুষ্ঠু তদন্ত হলে এই চক্রের নাম-পরিচয় জানা যাবে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. ইমরান আহমেদ গতকাল সমকালকে বলেন, ‘এই আগুন প্রাকৃতিকভাবে লাগেনি’।
গত বছরের তদন্ত প্রতিবেদন
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব বন বিভাগে গত ২৩ বছরে ২৭ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। এ সব ঘটনায় পুড়েছে অন্তত ১০০ একর বনভূমি।
আমুরবুনিয়ায় গত বছরের ৫ মে আগুনে পুড়ে যায় ৫ একর বনের গাছপালা। পরদিন খুলনা সার্কেলের সিএফ মিহির কুমার দোকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিছু দিন পর সেই কমিটি ‘সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির মূল্যায়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন’ জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে ভবিষ্যতের অগ্নিকাণ্ড এড়াতে ১৫টি সুপারিশ করা হয়।
যে সব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বনের ২৪, ২৫ ও ২৭ নম্বর কম্পার্টমেন্ট এলাকায় মার্চ থেকে মে পর্যন্ত মধু ও মাছসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। বনকর্মী ও কমিউনিটি প্যাট্রোল গ্রুপের সমন্বয়ে বিশেষায়িত বন অগ্নিনির্বাপক টিম গঠন করতে হবে। এরা মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বনের ২৪, ২৫ ও ২৭ নম্বর কম্পার্টমেন্টে টহল দেবে। এটা বাস্তবায়ন হয়নি।
অগ্নিকাণ্ডপ্রবণ এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত পুকুর খনন করতে হবে। আগুন লাগলে যাতে পানি সরবরাহ করা যায়। ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী ও খড়মা খাল গভীর ও প্রশস্ত করে খনন করতে হবে। ভোলা নদীর সংযোগ খালগুলোও খনন করতে হবে।
বনের ২৪, ২৫ ও ২৭ নম্বর কম্পার্টমেন্টের সীমানা বরাবর নাইলনের বেড়া এবং পর্যাপ্ত ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করতে হবে। লোকজন ও গবাদি পশু ঢোকা সীমিত করতে হবে। এই এলাকায় ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখতে হবে।
স্টেশন ও ক্যাম্পগুলোতে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম রাখতে হবে। এসব সরঞ্জাম দিয়ে অগ্নিকাণ্ডপ্রবণ আমুরবুনিয়া, গুলিশাখালী, নাংলি, ভোলা, দাসের ভারানী, জিওধরা ও ধানসাগর এলাকায় প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপণ কাজ চালানো যায়।
বনকর্মীদের অগ্নিনিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাপক সরঞ্জাম ব্যবহারের মৌলিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদীর পাশের এলাকার বনে অপেক্ষাকৃত আগুন প্রতিরোধী গাছপালা লাগাতে হবে।
জেলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সভা-সেমিনারে এলাকাবাসীকে আগুন প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করা। বন বিভাগ, কমিউনিটি প্যাট্রোল গ্রুপ ও ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমসহ যারা টহল এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা চালু করা। এসব সুপারিশের কোনোটি কার্যকর হয়নি।
যে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে
বনসংলগ্ন এলাকায় আগুনের ঝুঁকি, নেভানোর উপায় ইত্যাদি-সংক্রান্ত সাইনবোর্ড স্থাপন ও পোস্টার লাগানো, স্থানীয় লোকজনের মাঝে লিফলেট বিতরণ করা। বনে আগুন লাগানোর শাস্তি উল্লেখ করে মাইকিং করা। তদন্ত কমিটির এই সুপারিশ অনুযায়ী সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কিছু কার্যক্রম চালিয়েছে বন বিভাগ।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
তদন্ত কমিটির সদস্য ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. এস এম ফিরোজ জানান, তারা বিভিন্ন সুপারিশ দিয়েছিলেন বন বিভাগের কাছে। সেগুলোর কোনটা বাস্তবায়ন হয়েছে, আর কোনটা হয়নি তা তার জানা নেই। বন বিভাগ পরে আর কোনো কিছু জানায়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনার সমন্বয়কারী মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, প্রতিরোধ ও দ্রুত নির্বাপণের উদ্যোগ নেয়নি বন বিভাগ।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম বন বিভাগের অফিসগুলোতে নেই। নদী-খাল শুকিয়ে যাওয়া ও বনের মধ্যে পর্যাপ্ত পুকুর না থাকায় পানি সংকটে আগুন নেভাতে দেরি হচ্ছে।
খুলনা অঞ্চলের সদ্যবিদায়ী সিএফ মিহির কুমার দো বলেন, ভোলা নদী, আড়ুয়াবেড় ও খড়মা খাল খননের জন্য দরপত্র ডাকা হয়েছে। দু-এক মাসের মধ্যে খনন শুরু হবে। নাইলনের বেড়া দেওয়া হচ্ছে। দুই বছর আগে অগ্নিনির্বাপক কিছু সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে বন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
নতুন সিএফ ইমরান আহমেদ বলেন, ‘সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। সুপারিশগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। সবই যে বাস্তবায়ন হয়নি বিষয়টি এমন নয়।’