স্বজন হারাদের আহাজারি আর আত্মচিৎকারের মধ্য দিয়ে শীতলক্ষ্যায় ডুবে যাওয়া যাত্রীবাহী লঞ্চটি উদ্ধার করেছে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়। সেই সাথে এ পর্যন্ত ২৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

সোমবার দুপুর সোয়া বারোটার দিকে লঞ্চটিকে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় মাঝ নদী থেকে বন্দরের মদনগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে নিয়ে আসা হয় তখন ভেতরে কেবল লাশ আর লাশ দেখা যায়। উদ্ধারকারী দল লঞ্চের ভিতর থেকে ২১জন শিশুসহ নারী পুরুষের লাশ উদ্ধার করে। পরে নিমজ্জিত লঞ্চের কিছু দুরে আরো একজনের লাশ উদ্ধার করে। বিকালে আরো এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে রোববার রাতে ৫ নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। এ নিয়ে নিমজ্জিত লঞ্চের ২৯ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

গতকাল রোববার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে সদর উপজেলার চর সৈয়দপুর এলাকায় একটি কোস্টার জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি যাত্রীসহ ডুবে যায়। অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে মুন্সীগঞ্জ যাচ্ছিল। কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার সময় ১৫/২০ জন যাত্রী সাঁতরে তীরে ওঠতে সক্ষম হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

লঞ্চ ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে ঘটনার পর থেকেই বন্দর থানা ও বন্দর ফায়ার সার্ভিস কাজ শুরু করে। পরে এদের সাথে যোগ দেয় বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড, দমকল বাহিনী, নৌ ও সদর থানা পুলিশের উদ্ধারকর্মীরা। রাতে উদ্ধারকর্মীরা ৫ নারীর লাশ উদ্ধার করেছে বলে জানান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক। গতকাল বিকাল পর্যন্ত আরো ২৪ জনের লাশ উদ্ধার করার পর উদ্ধারকৃত লাশের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ জনে। দুপুর ২টায় বিআইডব্লিউটিএ লাশগুলো নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরের পর জেলা প্রশাসনের পক্ষে ইউএনও নাহিদা বারিক লাশগুলি স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন। এই মর্মান্তিক লঞ্চ ডুবিতে একই পরিবারের মা, দুই পুত্র। মা-মেয়ে। স্বামী-স্ত্রী। স্বামী-স্ত্রী ও শিশু কন্যা। স্বামী-স্ত্রী এবং স্বামী-স্ত্রী-কন্যাসহ ৬টি পরিবারের ১৫ জন লাশ হয়েছে। এদের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচ বোন বাবা-মাকে হারিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আর বলছিলেন, ‘আমি বাবা কমু কারে, মা কমু কারে?’ মাথা চাপড়ে এভাবেই কাঁদছিলো শীতলক্ষার লঞ্চ দুর্ঘটনায় মা-বাবা ও ছোট বোন হারানো মাহিন। তার আহাজারিতে আশেপাশে থাকা মানুষদের চোখও ভিজে উঠছিল।

নিহতরা হলেন- মুন্সিগঞ্জ সদরের নুড়াইতলী এলাকার মুখলেছের মেয়ে রুনা আক্তার (২৪), মোল্লাকান্দি চৌদ্দামোড়া এলাকার সমর আলী বেপারীর পুত্র সোলেমান বেপারী (৬০) ও তার স্ত্রী বেবী বেগম (৫৫), মালপাড়া এলাকার হারাধন সাহার স্ত্রী সুনিতা সাহা (৪০) এবং তার দুই পুত্র বিকাশ সাহা (২২), উত্তর চর মসুরা এলাকার অলিউল্লাহর স্ত্রী সখিনা (৪৫), একই এলাকার আরিফের স্ত্রী বিথি (১৮) ও তার মেয়ে আরিফা (১), মুন্সিগঞ্জ সদরের প্রীতিময় শর্মার স্ত্রী প্রতিমা শর্মা (৫০), মোল্লাকান্দি চর কিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিন (৯০) ও তার স্ত্রী রেহেনা বেগম (৬৫), উজিরপুরের খায়রুল হাওলাদারের পুত্র হাফিজুর রহমান (২৪) এবং তার স্ত্রী তাহমিনা (২০) ও পুত্র আব্দুল্লাহ(১), দক্ষিণ কেওয়ার দেবীন্দ্র চন্দ্র দাসের পুত্র নারায়ণ দাস (৬৫) ও তার স্ত্রী পার্বতী রানী দাস (৪৫), বন্দর উপজেলার কল্যান্দী স্কুল এলাকার একই এলাকার সোহাগের পুত্র আজমীর (১৫), মুন্সিগঞ্জ সদরের রিকাবিবাজার নূরপুর এলাকার মুশকে আলম মৃধার পুত্র শাহআলম মৃধা (৫৫), রতন পাতর এর স্ত্রী মহারানী (৩৭), ঢাকা শনিরআখড়া এলাকার রশিদ হাওলাদারের পুত্র আনোয়ার হোসেন (৪৫), তার স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৩০) ও মেয়ে মানসুরা (৭), নোয়াগাও পূর্বপাড়া এলাকার মিঠুনের স্ত্রী ছাউদা আক্তার লতা (১৮) ও লাতার বোন সাদিয়া (১১), শরিয়তপুর জেলার নরিয়ার মৃত নুরুন্নবী শেখের ছেলে আব্দুল খালেক(৭০), বরিশালের স্বরুপকাঠি এলাকার খাদিজা বেগম(৫০), ঝালকাঠির কাঠালিয়া এলাকার জিবু (১৩), বন্দরের সেলসারদি এলাকার নুরু মিয়ার ছেলে নয়ন(২৯) এবং একই এলাকার দোলা বেগম (৩৪)।

এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন মুন্সীগঞ্জের মৃত সুনিতা সাহার অপর ছেলে অনিক সাহা (১২), মধ্য কোন্ডাগাও এলাকার মতিউর রহমান কাজীর পুত্র ইউসুফ কাজী, ঢাকা মিরপুর-১১ এর বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামের পুত্র মো: সোহাগ হাওলাদার, টুঙ্গীবাড়ি বেতকা এলাকার মুছা শেখের পুত্র জাকির হোসেন (৪৫),মৃত আনোয়ার ও, মুন্সিগঞ্জ সদরের দক্ষিণ ইসলামপুরের মো: নুরুল আমিনের পুত্র মো: তানভীর হোসেন হৃদয়, মালপাড়া এলাকার সিরাজের পুত্র রিজভী (২০)।

এদিকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেকে তাদের স্বজনদের খোঁজে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে আর্তনাদ করেছে আর স্বজনদের খুঁজছে।

জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, ঘটনার তদন্তে ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠনছাড়াও র‌্যাব তাদের হেলিকপ্টার দিয়ে শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদীতে লাশ সন্ধ্যান চালিয়েছে। এছাড়া নৌ-পুলিশ তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

গত রোববার সন্ধ্যায় ডুবে যাওয়া এম এল সাবিত আল হাসান নামক যাত্রীবাহী লঞ্চটিকে উদ্ধারকারী জাহার প্রত্যায় গতকাল সেমাবার দুপুর সোয়া বারোটার দিকে লঞ্চটি তীরে আনা হলে ভেতরে ২১টি লাশ পাওয়া যায। পরে আরো ৩টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এনিয়ে লাশের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ জনে।

নারায়ণগঞ্জ নৌ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহিদুল আলম জানান, নারায়ণগঞ্জ সদরের চরসৈয়দপুর এলাকায় শীতলক্ষ্যায় নির্মাণাধীন সেতুর কাছাকাছি স্থানে এ ঘটনা ঘটে। একটি কোস্টার জাহাজের ধাক্কায় এম এল সাবিত আল হাসান নামের লঞ্চটি ডুবে যায়। নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে রওয়ানা হয়েছিল ডুবে যাওয়া লঞ্চটি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শীতলক্ষ্যা নদীর উপর নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারের নিরাপত্তকর্মী মোহাম্মদ হালিম বলেন, এসকেএল-৩ (এম: ০১২৬৪৩) নামের একটি কোস্টার জাহাজ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে অন্তত ২০০ মিটার লঞ্চটিকে টেনে নিয়ে যায। এরপর লঞ্চটি যাত্রীসহ ডুবে যায়।

সোমবার লঞ্চটি উদ্ধার শেষে বিআইডব্লিউউটিএ উদ্ধার কাজ সমাপ্ত করে। লঞ্চ ডুবির এই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউউটিএ কর্তৃপক্ষ ২টি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাহেরা খানম ববিকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়েছে।

অপরদিকে বিআইডব্লিউউটিএ’র পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) মো. রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাত থেকে শীতলক্ষ্যার পারে স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। শুধু কান্না আর কান্না। আপনজনদের খোঁজে স্বজনরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। তবে পুলিশ এখনো ঘাতক কার্গো জাহাজটি আটক করতে পারেনি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক জানান, উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে মরদেহগুলো ফায়ার সার্ভিসকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা শনাক্ত শেষে পরিবারের সদস্যদের কাছে মরদেহ বুঝিয়ে দেন।

সূত্রঃ মানবকণ্ঠ