শাড়ি নিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন- “শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে আবেদনপূর্ণ অথবা শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, মার্জিত এবং সুস্মিত পোশাক”।

শাড়ি সবচেয়ে প্রাচীন একটি সেলাইবিহীন পোশাক। এটি সবচেয়ে বহুমুখি, প্রচলিত ও সামসাময়িক যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলেই হারিয়ে যেতে হয় ইতিহাসের পাতায়। শাড়ি সেখানে ব্যতিক্রমী এক নাম। সর্বস্তরের নারীদের পরিহিত এই শাড়ি কালজয়ী কমনীয়তার প্রকাশ তুলে ধরে। শাড়ির ইতিহাস যুগ পরিবর্তনের হাওয়াতে সবকিছু বদলে গেলেও বাঙালি নারীদের সৌন্দর্য প্রকাশের জায়গায় এখনও চিরায়ত বাংলার শাড়ি দখল করে আছে অদ্বিতীয় মাত্রায়।

শাড়ির ইতিহাস প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক কালের ফ্যাশন ক্যাটওয়াক পর্যন্ত বিস্তৃত। অনাড়ম্বর ও বহুমুখি এই পোশাক ব্যবহারকারী নারীর গল্পই তুলে ধরে। দীর্ঘ আয়তক্ষেত্রাকার পোশাকটি ৫ হাজার বছর ধরে নারীর অন্যতম পোশাক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সেই পুরাকাল থেকে এখনও বজায় রেখেছে নিজের গরিমা।

বাঙালি নারী দেহে এক অবিসংবাদিত পরিধেয়। নারীর পরিধেয় বস্ত্র শাড়ির ইতিহাস কিন্তু আজকের নয়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৩ হাজার বছর বা তারও আগে থেকে রয়েছে শাড়ির উল্লেখ। বিভিন্ন নারী মূর্তির পরনে শাড়ি জড়িয়ে রাখার চল ছিল বলে মনে করা হয়। অবশ্য এখন শাড়ি বলতে আমরা যা বুঝে তার থেকে কিছুটা আলাদা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আগের দিনে নারীরা এক টুকরো দীর্ঘ বস্ত্র সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রাখতেন, সেটাই ছিল শাড়ি। ছিল না ব্লাউজ পেটিকোটের বালাই। তাও সমাজের নিম্ন আয়ের পরিবারেই ছিল এই পোশাকের প্রচলন। সেই শাড়িই কালক্রমে হয়ে দাঁড়ালো বাঙালি নারীর আভিজাত্যের পোশাক।

শাড়ি কথন

মডেল: শম্পা জামান

মধ্যভারতীয় আর্য ভাষায় ‘শাড়ি’কে আরও বিভিন্ন শব্দে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেমন-‘সাটক’, ‘সাটিকা’। আবার ‘মহাভারত’য়ে উল্লিখিত দ্রৌপদীর যে ‘বস্ত্রহরণ’ করা হয়েছিল, সেটাও অনুমিত হয়, শাড়িই ছিল। গুপ্ত যুগের (আনুমানিক ৩০০ থেকে ৫০০ সাল পর্যন্ত) বিখ্যাত কবি মহাকবি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, অজন্তা ইলোরারর গুহাচিত্রেও মেলে শাড়ির প্রচলনের ইঙ্গিত। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণকেও শাড়ি বলে চিত্রায়িত করা হয়ে থাকে।

গুপ্ত আমলের ইলোরা অজন্তা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলি বলে দেয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ির অস্তিত্ব ছিল। ইলোরা অজন্তার মতো পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে শাড়ির প্রচলন ছিল। তবে এসব শাড়ি পরার সঙ্গে আজকের শাড়ি পরার খানিকটা পার্থক্য রয়েছে। শাড়ির মতো পোশাকের প্রথম দিকের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতায়, যা উত্তর-পশ্চিম ভারতের ২৮০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিকাশ লাভ করেছিল। শাড়ি শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। এটির অর্থ ‘কাপড়ের টুকরো’। এটি মূলত তিন টুকরো কাপড়ের সমন্বয়ে তৈরি। এর মধ্যে এক টুকরো ছিল নিচের পোশাক (পেটিকোট), দ্বিতীয়টি বুকের (ব্লাউজ) ও তৃতীয় অংশটি পুরো শরীরে পেঁচিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে পরা হতো এবং এটির অগ্রভাগ দিয়ে ঢেকে রাখা হতো মাথা।

শাড়ির জনপ্রিয়তার সঙ্গে এর বহুমুখিতার একটি গভীর যোগাযোগ আছে। ‘প্রায় একশ উপায়ে শাড়ি পরা যেতে পারে। একই শাড়ি কেবল পরার ভিন্নতা এটিকে নৈমিত্তিক অথবা আনুষ্ঠানিক করে তোলে। ভারতের অঞ্চল ভেদে শাড়ি পরার ধরন খাদ্য ও আঞ্চলিক ভাষার মতো সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা’- বলছিলেন শাড়ি নিয়ে প্রায় ৮৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সিরিজ ‘দ্য শাড়ি সিরিজ’-এর সহ-নির্মাতা মালিকা ভার্মা।

তিনি বলেন, আমরা সমসাময়িক ভারতীয় ফ্যাশনে শাড়ি পরার আঞ্চলিক পদ্ধতিগুলো আবার নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং পোশাকটি ভারতীয় শহুরে নারীদের কাছে আরো সহজলভ্য করতে চেয়েছিলাম। ঐতিহ্যগতভাবে শাড়িগুলো ব্লাউজ ছাড়াই পরা হতো এবং বেশিরভাগ পরার ধরনেই পেটিকোট নেই।

শাড়ি কথন

মডেল: শম্পা জামান

ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না। এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরিধানে থাকলে হত ‘ধূতি’, আর মেয়েদের পরিধানে থাকলে ‘শাড়ি’। নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরের ওপরের অংশ উন্মুক্তই থাকত। তবে কখনও কখনও উচ্চবংশের নারীরা পালা-পার্বণে ওড়নাজাতীয় কাপড়ে নিজেকে ঢেকে নিত।

চৌদ্দ শতকের কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন— ‘নীল শাড়ি মোহনকারী/উছলিতে দেখি পাশ।’

প্রথম মা হওয়া নারীকে উপহার হিসেবে দেয়া হত লাল শাড়ি। শাড়ি পরার ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের বিভাজন ছিল। ধনী নারীদের শাড়ি ছিল মলমলের মিহি কাপড়ের। আর গরিবের শাড়ি ছিল সাধারণ সুতি কাপড়ের; তাও আবার ছেঁড়া। প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করা সুইয়ে তালি দেয়া শাড়ি পরতে হত তাদের। মুসলমানরা ভারতবর্ষে আগমনের ফলে এখানকার পোশাক-পরিচ্ছদেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। তুর্কি-আফগান-মোগল সংস্কৃতির ধারা স্থানীয়রাও গ্রহণ করেছিল। পাগড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও পায়জামার মতো পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও শাড়ির গুরুত্ব কমে যায়নি। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের নারীরা শাড়িকেই নিজেদের পরিধানের প্রধান বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে।

শাড়ি কথন

মডেল: শম্পা জামান

শাড়ি এক সময় বাঙালি নারীদের পরিধেয় হলেও তা ক্রমে জনপ্রিয় হয়েছে অবাঙালিদের মধ্যেও। শাড়ির পাড় কিংবা আঁচলের কাজে শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন নিজের মনের মতো ছবি। সে গ্রামের কোনো দৃশ্যও হতে পারে কিংবা আলপনার মতো করে কিছু ডিজাইন।

শিল্পীদের কাছে এও এক ক্যানভাস বটে। নানারকম দামী পাথর ছাড়াও সোনা-রূপার সুতা দিয়ে শাড়িতে নকশার কাজ করা হত। মোগলদের আগ্রহের জন্য মসলিনের শাড়ির উপস্থিতিও থাকত জেনানা মহলে।

মোঘলদের জন্য মসলিন কাপড় সংগ্রহের জন্য সরকারি লোক নিয়োগ দেয়া হত। আর সম্ভবত মোগল আমলে শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ বা বক্ষ ঢাকার রীতি চালু হয়। তবে তা উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সর্বসাধারণের মধ্যে ব্লাউজ পরার চলটা হয় ঠাকুর বাড়ির বউ এর পর থেকেই।

বিগত কয়েক দশক ধরে সস্তা শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় যন্ত্রচালিত তাঁতের শাড়িগুলো জনপ্রিয় হয়েছে। যন্ত্রের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তাঁতীদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠেছে। তবে বর্তমানে দাম বেশি হলেও হস্তনির্মিত শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কারিগররা আবার শাড়ি তৈরিতে ফিরে আসছেন। একটি সুন্দর শাড়ি হলো জীবন্ত ও দীর্ঘকাল ধরে চলা শিল্পের এক একটি টুকরো। এটি পুরো উপমহাদেশের ইতিহাস, তার কারিগরদের দক্ষতা এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যত্নসহকারে রাখা নারীদের স্মৃতি ধারণ করে। এটি যেন নারীদের শরীরে জড়িয়ে থাকা হাজার বছরের গল্প।

বাংলাদেশে শাড়ি শিল্প বেশ পুরান এবং প্রসিদ্ধ। যুগের সঙ্গে শাড়ির রঙচঙ আর উপাদানেও ঘটেছে বিশেষ পরিবর্তন। প্রস্তুতকরণে আলাদা হিসেব। নকশায়, ডিজাইনে। অনেক আগে আমাদের মসলিন শাড়ি দারুণ প্রভাব করেছিলো। অবাক করেছিলো বিশ্বকে। একটা সময় মসলিন শাড়ির চল উঠে গেছে। আমাদের মধ্যে এখন জামদানি-প্রীতি কাজ করে।

শাড়ি কথন

মডেল: শম্পা জামান

সুতির শাড়ি
সুতির শাড়ি ওজন অনেক হালকা। তাছাড়া ঘাম শুষে নেয়। কাজেই ঘাম ঝরানো গরমকালের জন্যে দারুণ এক শাড়ি। এতে শরীর ঠান্ডা থাকে।

মখমল শাড়ি
ব্যাপক জনপ্রিয় একটি শাড়ি। একেবারে হালকা ওজনের, কোমল এবং মসৃণ জমিনের এক শাড়ি। এটি এই সময়ের গরমের জন্যে আরামদায়ক।

ভিসকস শাড়ি
এ শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হলো, খুব সহজেই এতে রং করা যায়। এ রং কখনো নষ্ট হয় না। শাড়ির জমিন বাতাস চলাচলের উপযোগী করেই তৈরি।

লিনেন শাড়ি
ঘাম শুষে নেওয়া সুতায় তৈরি হয় লিনেন কাপড়। খুবই আরামদায়ক শাড়ি এটি। খুব সহজে বাতাস চলাচল করে। এটা শুধু দেহকে শীতলই রাখে না, এই ক্লাসিক শাড়িটি আপনাকে রীতিমতো বুঝতে পারে।

শিফন শাড়ি
এটি ওজনে অদ্ভুত রকমের হালকা। খুবই আরামদায়ক। এই শাড়ি কিনে কখনোই ঠকবেন না।

তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত