Select Page

বাংলাদেশ ও হিন্দুদের উপর হামলা নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি

বাংলাদেশ ও হিন্দুদের উপর হামলা নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক দফা দাবি এবং দেশজুড়ে তুমুল গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তিনি দেশ ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বেশ কিছু গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলা হয় যে, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুরা হামলার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে।

সে সময় থেকেই ভারতীয় মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মজুড়ে বিভ্রান্তিকর তথ্যসম্বলিত নিবন্ধ এবং ভিডিও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। টাইমস গ্রুপের মালিকানাধীন মিরর নাও-এর ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা? গণহত্যা, বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে নিহত। এছাড়া চারটি বাড়িতে সহিংসতা এবং অগ্নিসংযোগের ফুটেজ প্রকাশ করা হয়। সেখানে দাবি করা হয় যে এগুলো হিন্দুদের বাড়ি।

দ্য টাইমস গ্রুপের মালিকানাধীন মিরর নাউয়ের ইউটিউব চ্যানেলে ‘অ্যাটাক অন হিন্দু ইন বাংলাদেশ? ম্যাস মার্ডারস, কিলিংস বাই মব’ শিরোনামে একটি ভিডিও দেখানো হয়। চারটি বাড়িতে সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ফুটেজ দেখানো হয়েছে সেখানে। যার মধ্যে দুটি মুসলিমদের মালিকানাধীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভিডিওটির শিরোনামটি স্পষ্টতই বিভ্রান্তিকর, কারণ এ ঘটনায় কোনো গণহত্যার খবর পাওয়া যায়নি।

ভিডিওটিতে অসমর্থিত দাবিও করা হয়েছে, যেমন ‘জনতার হাতে ২৪ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে’ এবং ‘আক্রমণের কেন্দ্রে সংখ্যালঘুরা’।

আল-জাজিরা যাচাইকৃত তথ্য বলছে, সোমবার হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে মাত্র দু’জন হিন্দু নিহত হয়েছেন –একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং একজন হাসিনার আওয়ামী লীগের কর্মী।

কিন্তু পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে জানা যায় যে, এর মধ্যে দুটি বাড়ি মুসলিমদের। ওই ভিডিওর শিরোনাম স্পষ্টভাবেই বিভ্রান্তিকর কারণ এই ঘটনায় কোনো গণহত্যার খবর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, একটি বাড়ি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমানের।

২৪ ঘণ্টা ধরে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া এবং আক্রমণের কেন্দ্রে ছিল সংখ্যালঘুরা- ভিডিওতে এ ধরনের বেশ দাবিও করা হয়। আল জাজিরা স্বাধীনভাবে যাচাই করে জানিয়েছে যে, সোমবার হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে দুজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের এক কর্মী।

হিন্দুদের ওপর হামলার অনেক ভুয়া খবর ভারতী গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে এক কোটিরও বেশি শরণার্থী শিগগির পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের শীর্ষ নেতা শুভেন্দু অধিকারীর উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

মোদির সরকারের ঘনিষ্ঠ বার্তা সংস্থা এএনআই-এর এক প্রতিবেদনে ভারতের এক ছাত্র নেতাকে উদ্ধৃত করে বলেছে যে, এই গণ-অভ্যুত্থান ‘বাংলাদেশের শত্রুদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে।’

আরও উদ্ভট দাবি করেছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী ‘বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারকে ধ্বংস করেছে’।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ভারতীয় মিডিয়া ‘ইসলামোফোবিয়া’র দৃষ্টিতেই এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ভারতীয় মিডিয়ার বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের এই গণ-বিক্ষোভের পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রভাব রয়েছে।

কিছু গণমাধ্যম আবার আগ বাড়িয়ে সম্ভাব্য উদ্বাস্তু সংকটের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে। তারা বলছে, হিন্দুদের হয়তো বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। কিন্তু এ ধরনের দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এদিকে বিবিসির এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে যে, ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য যাচাই-বাচাই করে দেখা গেছে বেশিরভাগ খবরই গুজব।

এদিকে বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং সেদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে একটি বিশেষ কমিটি গড়েছে ভারত সরকার। আর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠার পর দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় হটলাইন চালু করতে চাইছে তারা।

বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর ‘ব্যাপক অত্যাচার’ হচ্ছে বলে যেসব ভুয়া পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এর বেশিরভাগই ভারতীয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল বলে ফ্যাক্ট-চেকাররা নিশ্চিত করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকেও এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

তারা এটাও বলছেন যে, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কিছু আক্রমণ হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে মুসলমানদের বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে, জ্বালানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, সম্পত্তি। ধর্মীয় পরিচয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৌণ ছিল, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্যই তারা হামলার শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের যেসব স্থানীয় নেতা-কর্মী পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন অথবা আসার চেষ্টা করছেন, তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে হিন্দু আর মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িতেই হামলা হয়েছে।

কিন্তু ভারত থেকে সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টিকে রাজনৈতিক না রেখে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন একাধিক ফ্যাক্ট চেকার। বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ ‘বিবিসি ভেরিফাই’-ও একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।

এ ধরনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় লোকজনকে মন্দির সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। অনেক স্থানেই মুসলিমরা সারারাত ধরে হিন্দুদের মন্দির পাহারা দিয়েছেন। কিন্তু এসব খবর ভারতীয় কোনো গণমাধ্যমে উঠে আসেনি।

চারদিকে যখন একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছিল, সে সময়ে ভারতের কিছু ‘ইনফ্লুয়েন্সর’ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভ্রান্তিকর ভিডিও শেয়ার করতে থাকেন যেন মনে হয় যে, বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার হচ্ছে।

এছাড়া এমন গুজবও ছড়ানো হয় যে, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থী ‘কট্টর ইসলামপন্থী’। সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নজর রাখে ‘ব্র্যান্ডওয়াচ’ অ্যাপ। তারা খুঁজে পেয়েছে যে চৌঠা অগাস্টের পর থেকে ভুয়া কাহিনীগুলি ছড়ানো হয়েছে এমন একটি হ্যাশট্যাগ দিয়ে, যেটি সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) সাত লক্ষ বার মেনশন হয়েছে।

যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রেন্ডিং পোস্টগুলো করা হয়েছে তার প্রায় সবই ভারতে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকাররাও গত কয়েকদিনের সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষণ করে অনেকটা একইরকম তথ্য পেয়েছেন যে, মূলত ভারতের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকেই হিন্দুদের ওপরে আক্রমণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে।

সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে, ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য অনেক অ্যাকাউন্ট থেকে সেই পোস্ট শেয়ার করে লেখা হয় যে, কট্টর ইসলামপন্থীরা তার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু যে বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছিল, সেটা যে আসলে বাংলাদেশের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার তা এখন সবার জানা।

আরেকটি ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের ইসলামী জনতা একটি মন্দিরে হামলা চালিয়েছে। চট্টগ্রামের ‘নবগ্রহ মন্দির’এর কাছে আগুন লাগানোর ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল। তবে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে মন্দিরে আগুন লাগেনি।

বিবিসি ভেরিফাইয়ের কাছে ছবি এসেছে যে, ওই মন্দিরের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে ওই মন্দিরের পেছনে অবস্থিত আওয়ামী লীগের একটি কার্যালয়ই আসল লক্ষ্য ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মন্দিরের কর্মকর্তা স্বপন দাস বিবিসিকে জানিয়েছেন, মন্দিরের পেছন দিকে অবস্থিত ওই দলীয় কার্যালয় থেকে চেয়ার-টেবিল বের করে আগুন লাগানো হয়েছিল। এই ঘটনা গত ৫ আগস্ট দুপুরের। অগ্নিকাণ্ডের পরের কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে যে, আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবিসহ বেশ কিছু পোস্টারও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

স্বপন দাস জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টাই মন্দির পাহারা দিচ্ছে মানুষ। আরও দুটি ভাইরাল হওয়া পোস্টে দেখা গেছে যে, বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু যাচাই করে দেখা গেছে যাদের ওপরে আক্রমণ করা হয়েছে তারা আসলে আওয়ামী লীগের নেতা এবং তারা মুসলমান।

এসব পোস্টই ভারতীয় অ্যাকাউন্টগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে ‘সেভবাংলাদেশিহিন্দু’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে সেসব শেয়ার করা হয় হিন্দুত্ববাদীদের ‘ভেরিফায়েড’ অ্যাকাউন্ট থেকে।

চট্টগ্রামের ‘শ্রী শ্রী সীতা কালী মাতা মন্দির’-এর বাইরে মুসলিম আর হিন্দু ছাত্ররা কথা বলছিলেন সম্প্রীতি নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে। তারা বলছেন, এসব গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য হলো একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করা, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করা। তবে আমরা ফাঁদে পা দেবো না।

সূত্রঃ জাগো নিউজ২৪

About The Author