পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়। আর সেবা খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে।
চিত্র-১ রাজধানীর উত্তরা পাসপোর্ট অফিস অসংখ্য মানুষ লাইনে দাড়িয়ে বায়োমেট্রিক দিতে মোট ৪টি লাইন অতিক্রম করতে হয়ে। এর মধ্যে নানা অজুহাতে আবেদন পত্র নিয়ে অনীহা করে দায়িত্বরত কর্মকর্তা, অনুরোধ করার পর আবেদন জমা নিলেও ঝুলিয়ে রাখে দিনের পর দিন। কারো দুই মাস আবার কারো ৩মাস। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে দায়িত্বরত আনসার এর মাধ্যমে কর্মকর্তাদের যোগ সাজশে অর্থের বিনিমিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ করিয়ে নেন। বর্তমানে সরাসরি ঘুষ না নিলেও গোপনে চলছে এমন অবৈধ কাজ।
চিত্র- ২ রাজধানীর আরিফা বেগম (ছদ্মনাম) পাসপোর্ট রি-ইস্যু করতে গিয়ে হয়রানীর স্বীকার হয়েছেন। পুরনো ৩টা পাসপোর্ট থাকা অবস্থায় ই-পাসপোর্ট করার সময় পুরনো পাসপোর্ট অনুযায়ী তার পিতা মাতার নাম ই-পাসপোর্ট আবেদনে উল্লেখ করে হয়রানির স্বীকার হয়েছেন। নতুন নিয়মে এনআইডিতে দেয়া নামে হতে হবে। আরিফার অভিযোগ এনআইডিতে মোহাম্মদ আব্দুল সংক্ষেপে দেয়া আর পুরনো পাসপোর্টে পুরো নাম। এখন বলছে ই-পাসপোর্টে এমন হবে না, তাহলে পুরনো পাসপোর্ট কিভাবে হয়েছে? এনআইডিতে অনেকের ভুলও আছে এগুলোর জন্য দায়ী কে?
ই-পাসপোর্ট একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে করার কথা থাকলেও আদতে সেটি পুরোপুরি ডিজিটাল মেথডে হয় না। স্মার্ট বা পুরো ডিজিটাল পদ্ধতি করতে হলে সকল কাজ অনলানে হবে, সকল ডকুমেন্টস অনলাইনে আপলোড হবে এবং ভেরিফিকেশনের পরই আবদেন কারীকে শুধু বায়োমেট্রিক এর জন্য তারিখ দিয়ে দিবে। কিন্তু বাস্তবে অনলাইনের নাম করে পাসপোর্ট অফিসে এসে ৩ দফা ম্যানুয়াল চেক করাটা হাস্যকর এবং হয়রানি ছাড়া আর কিছু নয়।
দীর্ঘদিন যাবত পাসপোর্ট অফিসের হয়রানি বা দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবে সেটার কোন প্রতিফলন ঘটেনি। হয়রানি বন্ধ হয়নি। পুরো সিস্টেম কে ডিজিটাল ও সহজ করার দাবি সকল মানুষের।
গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে এই প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ৮৬ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ, যেখানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৮৫ দশমিক ২ শতাংশ খানা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবা নিতে গিয়ে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ, বিচারিক সেবা পেতে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ, ভূমি সেবা পেতে ৫১ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেতে ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
টিআইবি বলছে, সার্বিকভাবে ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ খানা সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে। এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত খাতে ২০২৩ সালের মে থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেবা নিতে গিয়ে যেসব খানাকে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে, তার পরিমাণ গড়ে ৫ হাজার ৬৮০ টাকা।
সর্বোচ্চ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়কারী খাতগুলোর মধ্যে বিচারিক সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৩০ হাজার ৯৭২ টাকা), ভূমি সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ১১ হাজার ৭৭৬ টাকা), ব্যাংকিং সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৮১ টাকা) এবং বিআরটিএ সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৫৪ টাকা) অন্যতম।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই জরিপের মাধ্যমে দেশের জনসাধারণ বিভিন্ন সেবাখাত হতে সেবা নিতে গিয়ে যে দুর্নীতির শিকার হয় তার ধরন, ব্যাপকতা ও মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই জরিপের প্রধান উদ্দেশ্য সরকার, নীতি-নির্ধারক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অন্যান্য অংশীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যেন তারা জরিপের ফলাফল ও তার ওপর ভিত্তি করে টিআইবি প্রণীত সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
তিনি বলেন, জরিপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয়, বিচারিক সেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতি ও ঘুষের উচ্চহার অব্যাহত, যা সাধারণ জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা। অন্যদিকে ভূমি সেবা, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিআরটিএ’র মতো সেবায় উচ্চ দুর্নীতি ও ঘুষ বিদ্যমান, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় সেবাপ্রাপ্তির অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
টিআইবি’র জরিপ বলছে, যেসব খানার মাসিক আয় ২৪ হাজার টাকার কম, তাদের বার্ষিক আয়ের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ শুধু ঘুষ হিসেবে খরচ করতে হয়। আর মাসিক আয় ৮৫ হাজার টাকার বেশি এমন খানার ক্ষেত্রে এ হার শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ।
প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও হয়রানির ভয়ে দুর্নীতির শিকার খানাগুলোর অভিযোগ জানাতে অনীহা রয়েছে জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি সম্পর্কে একদিকে বেশির ভাগ খানার কোনো ধারণা নেই, যাদের আছে তারাও বিশেষ করে দুদক ও জিআরএস সম্পর্কে খুব কম ধারণা রাখে। অন্যদিকে, যারা অভিযোগ করেছে তাদের প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এবং প্রায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ গ্রহণ করা হয়নি, যা দুর্নীতির প্রতিকারে প্রবল অনীহা ও অব্যবস্থাপনাকে নির্দেশ করে।
এদিকে জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ করেছে টিআইবি। যার মধ্যে রয়েছে-সেবা খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। অনলাইনে সেবাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে যথাযথ প্রচারণা চালানো। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস চালু করা এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
সেবাদানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেবাদাতার জন্য যুগোপযোগী আচরণবিধি প্রণয়ন করা; যেখানে কোন সেবা কীভাবে ও কতো সময়ের মধ্যে দিতে হবে, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে ইত্যাদি উল্লেখ করা থাকবে। প্রত্যেক সেবাগ্রহণের পর সেবাদাতার মতামত নেয়ার ব্যবস্থা করা। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পদোন্নতি, পদায়ন ও পুরস্কার দেয়া বন্ধ করা। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নাগরিক সনদে সেবার মূল্য ও সেবাপ্রাপ্তির সময় সম্পর্কিত তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে স্থাপন করা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কার্যকর করা যেখানে সেবাগ্রহীতার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে। যেসব খাতে জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের কারণে সেবাদান ব্যাহত হয়, সেসব খাতে বিদ্যমান ঘাটতি দূর করা। সেবাদাতা সব প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা।
অভিযোগগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানি ও সামাজিক নিরীক্ষার মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করা। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী বার্ষিক ভিত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে হালনাগাদ করে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা। দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী সম্পর্কে কোনো অভিযোগ আসলে তা যাচাই করা এবং কোনো প্রকার অসঙ্গতি পাওয়া গেলে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তথ্যসূত্র: মানবজমিন