কক্সবাজারে গত কয়েকদিন ধরে আলোচনার তুঙ্গে সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং প্রাণনাশের হুমকির মুখে আছেন। গণমাধ্যমের এমন সংবাদে কক্সবাজারের সচেতন মহলে মাঝে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
শরীফ উদ্দিনের বরখাস্তের ঘটনায় বিভিন্ন প্রকল্পে অধিগ্রহণের অর্থের প্রকৃত দাবিদাররা হতাশ। তারা মনে করছেন, এই ঘটনায় দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবেন। ফলে তারা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
অন্যদিকে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দুর্নীতিবাজদের উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তাদের ভাষায়, টাকা না পাওয়ায় শরীফ উদ্দিন তাদের বিরুদ্ধে লেগেছিলেন। যার কারণে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হয়েছে। শরীফ উদ্দিনের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে উল্লাস প্রকাশকারীরা বলছেন, সে যদি এতোই সৎ হয় তাহলে গত রমজানের সময় কক্সবাজার আওয়ামী লীগের একজন নেতা ও জনপ্রতিনিধির বাসায় কেন গোপনে গিয়েছিলো ? ওই নেতার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যার তদন্ত করছিলো শরীফ উদ্দিন। কক্সবাজার সচেতন মহলের ধারণা এইসব রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তদন্ত করতে গিয়েই শরীফ উদ্দিন ফেঁসে গেছেন।
জানাযায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় কক্সবাজারে ৭২টি প্রকল্পে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, রোহিঙ্গাদের ২০টি এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু দুর্নীতি বিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি মামলা দায়ের করেন। এতে তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। গত বছরের ১৬ জুন তাকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়।
তিনি চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে হালনাগাদ ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
একইভাবে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলামের বড় ছেলে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন শরীফ উদ্দিন।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পিবিআই অফিস তৈরির জন্য এক একর জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতি, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে খালাসি পদে ৮৬৩ জনকে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপকসহ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন শরীফ উদ্দিন।
এদিকে, কক্সবাজারে তিন লাখ কোটি টাকার ৭২টি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের শুরুতেই ভূমি অধিগ্রহণে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতার সহায়তায় দুর্নীতির এ জাল বিস্তারের তথ্য পাওয়া গেছে। কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কিছু কর্মকর্তার নামও এ চক্রে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য পৃথক তিনটি মামলা করে দুদক। তদন্তকারী কর্মকর্তার ৭৫০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ২৩ পদস্থ কর্মকর্তাসহ মোট ৪৪ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়।
এ ছাড়া দুদকের তালিকায় দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে সাতজন রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে, যাঁদের মধ্যে আছেন কক্সবাজার আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা, মহেশখালী উপজেলার কালামারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান এবং কক্সবাজার যুবদলের সভাপতি।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে কক্সবাজারের পাঁচজন সাংবাদিক, আটজন আইনজীবী, দুজন ব্যাংকারের নাম উঠে আসে, যাঁরা কোনো না কোনোভাবে ওই দুর্নীতি ও দালাল চক্রের অংশ হিসেবে কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, তাঁরা সবাই সরকারি অর্থ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের না দিয়ে আত্মসাৎ করতে ভূমিকা রেখেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন দাবি করেন, স্থানীয় পর্যায়ে ভূমি অধিগ্রহণ কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি থাকলেও মূলত কাজটি মাঠ পর্যায়ে সার্ভেয়াররা করে থাকেন। তাঁদের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তিনি অনুমোদন দেন। তাঁর ভাষ্য, ‘জেলা প্রশাসন থেকে আমরা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করে দেখেছি। কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।‘
যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তারাই যদি তদন্তের দায়িত্ব পালন করে তাহলে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়ারই কথা। দুদকের পক্ষে তদন্ত পরিচালনাকারী কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘কক্সবাজারের কয়েকটি মেগা প্রকল্পের দুর্নীতি অনুসন্ধানে আমি সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা ও একটি দালাল চক্রের রোষানলে পড়ি। তারা আমাকে তাদের নাম তদন্তে না দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু দুর্নীতির প্রমাণ থাকায় আমি তাতে সম্মত হইনি। তাদের হত্যার হুমকিতে আমি জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত আছি।’
বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজারের সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেছেন, এত দিন আমরা বিভিন্ন চলচ্চিত্রে দেখেছি, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কারণে সৎ পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা সরকারি কর্মকর্তাকে প্রভাব খাটিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। এখন তা বাস্তবে দুদকে দেখলাম। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এলাকায় বড় প্রকল্প ও সরকারি অফিসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শরীফ উদ্দিনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী। তিনি কারও সঙ্গে আপস করেননি। তাকে কেন চাকরিচ্যুত করা হলো, তা দুদকের পরিষ্কার করা উচিত।
যে ক্ষমতাবলে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতির আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেই দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-তে বলা হয়েছে, ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোনো কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা ৯০ দিনের বেতন পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।’
অবশ্য এই আদেশকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, সংবিধানের ১৩৫ (২) নম্বর অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, অনুরূপ পদে (প্রজাতন্ত্রের অসামরিক পদে) নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসংগত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না।’
উল্লেখ্য, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুদক কর্মচারী চাকরি বিধিমালা ২০০৮ এর ৫৪(২) বিধি অনুযায়ী দুদক চেয়ারম্যান মো. মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করেন। তিনি সর্বশেষ পটুয়াখালী দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তাকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনায় দুদকের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় তার সহকর্মীরা মানববন্ধন করেছেন।
সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ
Aninda, Sub-Editor