সবারই মাথা গরম।

ফেসবুকে একজন আরেকজনকে আনফ্রেন্ড করছে, ব্লক করছে। সবাই স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিপক্ষে সে আমার ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে বেরিয়ে যাক!

একজনের স্টেটাসে গিয়ে আরেকজন কমেন্ট করছে, সারাজীবন আপনাকে শ্রদ্ধা করে এসেছি, আজকের দিনে আপনার থেকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম… ইত্যাদি!
আসলে ঘটছেটা কী?
আমার নিজস্ব দুই পয়সার মতামত দেয়ার আগে আসুন গত কয়েকদিনের চলমান ঘটনার দিকে একটু ফিরে তাকাই।
১.
কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হয়েছে, তখন ফেসবুকে কারো কোনো নড়াচড়া দেখা যায় নি। এটা ছিল মোটামুটি ছোট একটা খবর। টিএসসি ক্যাম্পাসে ছাত্ররা ছাড়া এটার উত্তেজনা কেউ টের পাচ্ছিল না।
২.
প্রধানমন্ত্রী বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা কোটা সুবিধা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?
এই কথায় আন্দোলনরত ছাত্ররা ক্ষেপে গেল। তারা স্লোগান দিল, তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!
৩.
এবার ক্ষেপে গেল সারা জাতি। তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে রাজাকার বলবা, ফাইজলামি পাইসো? রাজাকার মানে বোঝ?
ক্ষেপে যাওয়ার সঙ্গত কারণ আছে। মুক্তিযুদ্ধের দগদগে ক্ষত যার মনে আছে, রাজাকার শব্দের প্রতি তার ঘৃণা একমাত্র সেই অনুমান করতে পারে।
এই ঘৃণা একজন নাৎসি সৈন্যের প্রতি একজন ইহুদি শিশু ঘৃণার চেয়েও বেশি।
৪.
এবার জানা গেল ওই স্লোগানটা পরিপূর্ণ স্লোগান না। ছাত্ররা স্লোগান দিয়েছে, তুমি কে? আমি কে?/ রাজাকার! রাজাকার! /কে বলেছে? কে বলেছে?/ স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!
এই স্লোগান নিয়েও যথেষ্ট তর্কবিতর্ক আছে।একদল বলছে দ্বিতীয় অংশ পরে ঢোকানো হয়েছে, আরেকদল বলছে দ্বিতীয় অংশ শুরু থেকেই ছিল।
৫.
এরপরও ছাত্ররা সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পায় নি। কারণ যে কোনো মূল্যেই তুমি নিজেকে রাজাকার বলতে পার না। এটা কোনো আন্দোলনের ভাষা হতে পারে না।
সব জায়গায় ছাত্ররা এই ভাষায় আন্দোলনের জন্য নিন্দিতই হচ্ছিল।
৬.
পরিস্থিতি ঘুরে গেল যখন ছাত্রলীগের বিখ্যাত হেলমেট এবং হাতুড়ি বাহিনী ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! সেই সঙ্গে পুলিশ।
রংপুরে একজন সাঈদ নামের এক ছাত্রকে পাখির মতো গুলি করে মারা হল সর্বজনসমক্ষে। আরো পাঁচজন ছাত্র মারা যাওয়ার খবর শুনেছি।
সরকার পক্ষের পেটোয়াবাহিনীর হামলার পর সমস্ত জনসাধারণের সমর্থন পুরোপুরি ঘুরে চলে গেল ছাত্রদের প্রতি।
৭.
ছাত্ররা যখন নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিচ্ছে, তখন লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কোটা নিয়ে একটি কলাম লিখে মাত্র শেষ করেছেন।
লেখা শেষ করে তিনি খবর পেলেন ছাত্ররা নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিচ্ছে।
তখন তিনি তার কলাম পরিবর্তন করে শেষ অংশটুকু এভাবে লিখলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমি আর কখনোই সেখানে যেতে চাইব না। কে জানে ছাত্র-ছাত্রীদের দেখলেই হয়ত মনে হবে, এরাই হয়ত সেই রাজাকার!
৮.
এই লেখা যখন প্রকাশ পেল ততক্ষণে ছয়জন ছাত্র নিহত হয়েছেন। এমন সময়ে উনার এই লেখা কাজ করল বারুদের স্তুপে আগুনের ফুলকির মতো!
বাংলাদেশে লেখক ও ব্যক্তি হিসেবে এককালের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটি রাতারাতি পরিণত হলেন সবচে বড় ঘৃণার পাত্রে। হায় নিয়তি!
৯.
এখন পরিস্থিতি হচ্ছে এমন, সবাই মিলে একটু খ্যাত বা আলোচিত সব ফেসবুক সেলিব্রিটির পেইজে যাচ্ছেন এবং ছাত্রহত্যা নিয়ে কেন কোনো পোস্ট নেই এই নিয়ে যারপরনাই ঝেড়ে দিচ্ছেন।
রাজাকার স্লোগান নিয়ে সমালোচনার সুরে কথা বললেই পাল্টা সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে সমর্থনের সুরে কথা বললে গালিগালাজের বন্যা ছুটছে!
১৭ জুলাই বাংলাদেশের মধ্যরাত পর্যন্ত এই হচ্ছে পরিস্থিতি।
…এইবারে আমার মতামত দেই।
১.
কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্রদের একটা খুবই সাধারণ নিরীহ আন্দোলন ছিল, এটাকে এতদূর টেনে আনা দরকার ছিল না। সরকারের গোঁয়ার্তুমি ও বোকামি ও নিষ্ঠুরতা এতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
২.
ছাত্ররা এরকম কোনো আন্দোলনে হয়ত নামতই না। নেমেছে এর একটা বড় কারণ হল প্রচুর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে তার পরিবার এবং নাতিপুতির জন্য চাকরি নিশ্চিত করেছে।
সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মনে এই ধরনের প্রক্রিয়া প্রবল হতাশা যোগ করাই স্বাভাবিক। এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আটকানো গেলে এই কোটার প্রতি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধা বলবৎ থাকত। এই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠত না।
৩.
মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% অথচ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১০% এর বেশি এই কোটায় চাকরি পায়ই না।
তাহলে ঘটনাটা কী দাঁড়াল? অনায়াসেই এই কোটা সংস্কার করা যেত। জটিল হলেও এর সমাধান করা যেত। সরকার তা না করে ছাত্রদের রক্ত হাতে মেখে নিল। এর মূল্য একসময় না একসময় তাদেরকে দিতেই হবে।
৪.
আর প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, কোনো মূল্যেই আপনাদের নিজেদেরকে রাজাকার বলে স্লোগান দেওয়া উচিত হয় নি। যতই মেটাফোর, রূপক ইত্যাদি বলেন না কেন, যত কষ্টদুঃখের কথাই বলেন না কেন, আপনাদেরকে আপনারাই কলঙ্কিত করেছেন।
রক্ত ঝরার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আপনাদের প্রতি সাধারণ মানুষের সেই অর্থে কোনো সমর্থন ছিল না, এই এক রাজাকার স্লোগানের কারণেই।
৫.
আপনাদের আন্দোলন নিশ্চয়ই সফল হবে। কোটা সংস্কার করা হবে। কিন্তু একথাও মনে রেখেন, লাখ লাখ শহীদের রক্ত আর ধর্ষিতার চোখের পানিতে সিক্ত দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনি ব্যাঙ্গার্থে হলেও নিজেকে একবার রাজাকার বলেছিলেন।
আপনারা যারা বিবেকবান ছাত্র, তাঁরা অবশ্যই একসময় এর জন্য লজ্জিত বোধ করবেন।
৬.
নিজেকে রাজাকার বলে ব্যঙ্গাত্মক স্লোগান দেবার শুরুটা হয়েছিল ভিপি নূরার সময়। তখনো মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ছাত্রদের গায়ে ‘আমি রাজাকার’ লেখা পোস্টার দেখে এর বিরুদ্ধে কলাম লিখে অজনপ্রিয় হয়েছিলেন।
তখন ছাত্রদেরকে ভিপি নুরা একবার খেলে দিয়েছিল।
এবার কে খেলে দিয়েছে জানি না। নিজেকে রাজাকার বলে আত্মম্ভরী স্লোগান দেয়ার বুদ্ধি কার মাথা থেকে এসেছে বলতে পারি না। পরে যদি জানা যায় ছদ্মবেশী ছাত্র হয়ে জামাত শিবির এসে খেলে দিয়েছিল তাতে অবাক হব না!
৭.
ফেসবুকের পাতায় পাতায় স্ট্যাটাসে স্ট্যাটাসে শেখ হাসিনার সরকার, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ছাত্রলীগ এদেরকে নিয়ে প্রবল গালিগালাজের খেলা চলছে, যেটা খুবই স্বাভাবিক।
উত্তেজিত ছাত্র ও তরুণরাই এই সমালোচনা ও গালিগালাজ করে চলছে। তবে চিন্তিত হবার বিষয় হল, বিভিন্ন জায়গায় তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আরো অন্য যেসব লোকজন গালিগালাজ করছে এরা কেউ ছাত্র বা তরুণ নয়।
এদের মধ্যে প্রচুর লকড আইডি, দাড়ি-টুপিঅলা হুজুর যারা তাদের ওয়ালে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রেখেছে।
সময়ের সুযোগে আজকে এরা এক কাতারে ভিড়ে গেছে। যথেষ্ট চিন্তার বিষয়।
৮.
আমার কথা খুব সহজ।
এই আগ্রাসন এবং আক্রমণের জন্য সরকারের প্রতি ঘৃণা। কোনো রক্তপাত না ঘটিয়ে সুষ্ঠুভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যেত।
আর কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন এবং সহানুভূতি রয়েছে।
তবে সহানুভূতি ও সমর্থনের পাশাপাশি খুব সূক্ষ্ণ এবং শীতল একটা ক্রোধও রয়েছে। আপনার নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিয়েছিলেন এটা ভুলতে পারছি না।
এতে যদি আপনারা বিরক্ত হন অনায়াসে আমাকে গালিগালাজ দিয়ে যেতে পারেন। আপনাদের গালি অবশ্য আমি গায়ে মাখব না।
৯.
এই আন্দোলনে প্রাণ গেছে ছয় শিক্ষার্থীর, আর মান গেছে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের।
প্রধানমন্ত্রী, হাতুড়ি বাহিনী, পুলিসের ওপর যত রাগ সব গিয়ে পড়েছে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ওপর।
সব তরুণ তরুণীরা ঘোষণা দিচ্ছেন আর জীবনও তাঁর বই পড়বেন না।
ঘরে তাঁর যেসব বই জমা আছে সেগুলো কেজি দরে বিক্রি করে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বইপোকার আড্ডাখানা নামক বইয়ের পেজ সারাজীবনের মতো তাঁর বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
উনার কিন্তু আসলে এত ঘৃণা প্রাপ্য ছিল না।
শাবির আন্দোলনের সময়, বইমেলায় নাস্তিকতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা বইয়ের সময় তাঁর বক্তব্য আমিও সমর্থন করতে পারি নি।
কিন্তু সব সময় জেনেছি ও বুঝেছি উনি যা বলেছেন তা নিজের বিশ্বাস থেকে বলেছেন, দালালি করে কাউকে খুশি করতে বলেন নি।
অজনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা সত্ত্বেও যা বিশ্বাস করেছেন তাই বলেছেন। অথচ হাওয়া বুঝে নিজের অবস্থানের বিপক্ষে কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কিছু লোক তো সারাজীবন জনপ্রিয়ই থেকে গেল।
এইবারে তো বেচারার আমি কোনো দোষই দেখি ন। ছাত্ররা নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিয়েছে, সবাই এর নিন্দা করেছে।
জাফর ইকবালও তাঁর কলামে তাই করেছেন।
এরপর গুলি চলল, রক্ত ঝরল। জনতা ছাত্রদের স্বপক্ষে চলে এল। ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রকাশ পেল জাফর ইকবালের কলাম। তখন তার ওপর সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল! সেই দলে সে লোকও আছে, যে কিনা আগের দিই ছাত্রদের নিন্দা করে ফাটিয়ে ফেলেছে!
অথচ উনি কোটা সংস্কারের পক্ষপাতী একজন মানুষ। অপরিণদর্শী অভিমানী দুই লাইনের জন্য তাকে গণশত্রু বানিয়ে ফেলা হল!
উনি আসলে একটি পরিবেশ পরিস্থিতি যাচাই না করে কথা বলা একজন ‘বোকা বুড়ো’।
যে যাই বলুক, আমি এই বোকা বুড়োর সঙ্গে আছি।
আমরা যারা সবাই হাওয়া বুঝে কথা বলি, তাদের ভিড়ে হাওয়া বুঝতে না চাওয়া মানুষের দরকার আছে।
উনি ভুল কথা বলেন, অযৌক্তিক কথা বলেন, অন্যায় কথা বলেন কিন্তু মন খুশি করা ‘মিথ্যা কথা’ বলেন না।
উনি কখনো কখনো ‘বিরক্তিকর’ কিন্তু ভণ্ড না।
প্রিয় সহলেখক ও বন্ধু দ্রোহী একবার বলেছিলেন, যে যাই বলুক, ছাগু পোন্দানোর যুদ্ধে জাফর ইকবাল সবসময়েই আমাদের জেনারেল ছিলেন ও থাকবেন।
আমারও তাই মত।
জাফর ইকবালই মুক্তিযুদ্ধের ফিল্টারে আমাদেরকে রাজাকার চিনতে শিখিয়েছিলেন।
তাঁর অসাধারণ সব শিশুসাহিত্যগুলো পড়ে আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা পেয়েছে, রাজাকারের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বড় হয়েছে।
একটা গোটা প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ চেতনা গড়ে দিয়েছেন তিনি।
তাঁর অপরিণামদর্শী বাক্যের জন্য তাঁকে ছেড়ে যাওয়া আমার অন্তত পোষাবে না। এতটা অকৃতজ্ঞ হওয়া যায় না।
— মৃদুল আহমেদ