নূপুর পড়া ধবধবে পা দুটো সাদা বালির উপর অল্প স্বচ্ছ পানিতে নীল শাড়ির আভায় পড়ন্ত বিকেলের রোদে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য এনে দিয়েছে,

পাশের মানুষটির জিন্স প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত তোলা নগ্ন পা,পায়ের সাথে পা মিলিয়ে মেয়েটির হাতে হাত রেখে সমান তালে হেঁটে চলছে।

এলোমেলো চুল গুলো বার বার মুখের উপর চলে আসছে, শাড়ির নীচের অংশ টুকু ভিজে যাচ্ছে মেয়েটির।
যাক ভিজে! হোক চুল এলোমেলো!
বিশাল সমুদ্রের গর্জনে, পাশের মানুষটির নিস্তব্ধ মুগ্ধতায় নিজে এতটাই আবিষ্ট হয়েছে যে,মেয়েটির মুখ থেকে কোনো কথাই বেরুলো না।

চৈতন্য ভাংলো ঝিনুকের মালা হাতে ছেলেটি।
“নেন স্যার আপার জন্য একটা মালা নেন।”
না না লাগবে না বলে মেয়েটি আবার হাঁটার চেষ্টা করলো,
কিন্তু পাশের ছেলেটি দাঁড়িয়ে একটা মালা কিনে দাম মিটিয়ে মেয়েটির হাতে মালাটি দিয়ে বলল,
“আজ সবকিছু তোমার, এ-ই দিন তোমার, সমুদ্রে পরে থাকা সমস্ত ঝিনুক তোমার, সমুদ্রের অতলে যত ঐশ্বর্য সব তোমার,
এই মুঠো ভর্তি বালি , অবেলার রোদ, দূর আকাশের নীলের সমপরিমাণ ভালোবাসা সব তোমার।”
মেয়েটির আনন্দে চোখের সাগরে জোয়ার উছলে উঠলো।

পা দুটো ও যেন হাঁটার শক্তি কেড়ে নিল।
ছেলেটি বুঝতে পেরে মেয়েটির পিছনে হাতদিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো।
মেয়েটির মনের ভেতর গানটি বেজে উঠলো, “ঐ ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় আমার ইচ্ছে করে,
আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায় তোমার হাতটি ধরে…
অই তয়লাটা দ্যাও,বাথরুমের ভেতর থেকে মুখ বের করে নীলুর স্বামী বলে ওঠাতে ওর সম্বিত ফিরে এলো।

অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে তাই নাস্তা বানানো, খাওয়ার পর একটু তন্দ্রা চলে আসছিল।
কতক্ষণ নীলু এভাবে চোখ বন্ধ করে ভেবে যাচ্ছিল তা ঠাহরে না আসলে ও তার স্বামীর “দ্যাও” কথাটা শুনে পিত্তি জ্বলে উঠলো।
ক্যান দ্যাও শব্দ থেকে কি দাও শব্দ বেশি কঠিন?

হ্যাঁ নীলু প্রচন্ডরকমের সৌখিন একটি মেয়ে,বন্ধুবান্ধবদের আসরে তার শৈল্পিক কথায় একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে সবাই ওর কথাই শুনে যেত।ওর চালচলনে মার্জিত ও গোছানো ভাব ফুটে উঠতো।
মধ্যবিত্ত অস্বচ্ছল পরিবারেই জন্ম নিয়ে ও রুচিবোধের ভিন্নতায় নীলুর স্বতন্ত্র ভাবটি কারো চোখই এড়ায়নি।

কত ছেলে যে ওর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে তার কোনো হিসেব নেই।
বাবার অসুস্থতার কারণে, পড়ালেখা শেষ হওয়ার আগেই এক ধনী পরিবারে ওর বিয়ে হয়ে যায়।
স্বামী হিসেবে মামুন যথাসাধ্য চেষ্টা করে নীলুকে খুশি রাখার।শাড়ি, গয়না,বাড়ি গাড়ি কোনো কিছুরই অভাব রাখেনি।

বিয়ের পরদিন সকালে সবার সাথে নাস্তা পর্ব শেষ করার পর, চা ঘরে দিয়ে গেলে নীলু ভেবেছিল দুজনে গল্প করবে আর আরাম করে চা খাবে।

ফুরুৎ ফুরূৎ শব্দে মামুন যখন খাচ্ছিলো, নীলু প্রায় হতবম্ব হয়ে তা দেখছিল। আরো অবাক হয়ে ছিল, মামুন যখন বলে উঠলো,
“বুজলা নীলু, খাওয়া যতই তুমি জিহবার সাথে পিষ্যা খাইবা,ততই তুমি খাওয়ার মজা পাইবা।
এই যে চা, তুমি একটু পিরচে ঢাইল্লা খাইয়া দেখ কেমন লাগে!”
নীলু পুরোই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে কখনোই একসাথে খাওয়াটা ওর কাছে আনন্দদায়ক মনে হয়নি।

কত স্বপ্ন দেখেছিল স্বামীর পাশে অচেনা মুগ্ধতা নিয়ে সন্ধায় রিকশা ঘুরবে,গিয়ে ও ছিল একদিন মামুন কে নিয়ে।
কিছুদুর যাওয়ার পর রিকশা কেন আস্তে চালায় এই নিয়ে রিকশাওয়ালার উপর সে-ই কি রাগ! যত নোংরা ভাষায় গালিগালাজ।

অগত্যা নীলু বাড়িমুখো রওনা হয়।
সামান্য বিষয় নিয়ে ও মামুন যখন নীলু কে অকথ্য ভাষায় জর্জরিত করে এবং একটু পরেই মাফ চায়, আবার এও বলে এটা তার অভ্যাস। মন থেকে সে কিছুই বলে নি,তখন চোখ ছাপিয়ে জলের বন্যা বয়ে যায় নীলুর।

বিছানা ভাগ করে শোয়া,সংসারের যাবতীয় কাজকর্মে অংশগ্রহণ ছাড়া নীলু মামুনের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করেনা।

অবচেতন মনের সুক্ষ্ম চাওয়াটা নীলু পূরণ করে কল্পনার জাল বুনে।সে যখন একা থাকে, ওর মনের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুক্ষ্ম সৌন্দর্যের মানুষটি বিচরণ করায় ওর স্বপ্নের লীলাভূমিতে,
যেখানে কখনো থাকে সমুদ্র সৈকত, কখনো ছোট্ট কোনো দ্বীপ, কখনো ও সোডিয়াম লাইটের আলোতে হাতে হাত রেখে রিকশায়,
কখনো টং দোকানের কোনো চায়ের কাপে…
মামুন বাথরুম থেকে বের হয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়ে বলল “তাড়াতাড়ি আমারে নাস্তা দ্যাও।”

যথারীতি নাস্তা খেয়ে বের হতে গিয়ে কী মনে হলো, সে নীলুর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“অনেক দিন কোথাও যাই না,সামনে সাপ্তায় আমার ব্যবসার কাম কম আছে, চলো কোথাও ঘুইরা আহি।”
নীলু সাময়িক উচ্ছ্বসিত হলেও সাথে সাথে নিস্প্রভ হয়ে গিয়ে বলল,”তোমার সাথে কোথাও গেলেই তুমি ঝগড়া বাঁধাও, আমি যাবো না।”

মামুন জিহবায় কামড় দিয়ে কান ধরে বলে উঠলো, “না না আমি কোনো কাইজা ঝগড়া করুম না,পাক্কা।”
আর তুমি যে বাংলা সিনেমার ডিপজলের মতো কথা বলো এর কি হবে? অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করে নীলু।

এইটা তো আমার মায়ের ভাষা, আমার প্রাণের ভাষা। তয় তোমার সাথে থাকতে থাকতে তুমি ও তো আমার প্রাণ হয়া গেছ,তোমার মতো কথা বলতেই আমি চেষ্টা করুম।

এই বার লক্ষী বউ আমার কও কই যাইবা?
মামুনের প্রশ্নে সাথে সাথে বলে উঠে নীলু সেন্ট মার্টিন!
আচ্ছা,বলেই হেসে উঠে মামুন নীলুকে কাছে টেনে নেয়।

লেখক- জেসমীন আক্তার