মহাখালীর খাজা টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় পুরো দেশের ইন্টারনেট সেবা বিপর্যস্ত করেছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটেছে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা এবং মোবাইল নেটওয়ার্কের সংযোগে।

প্রশ্ন হচ্ছে, একটি ভবন থেকে কিভাবে সম্পূর্ণ ইন্টারনেট সেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হলো?

কী ঘটেছে?

ভবনটিতে আগুন লাগে বৃহস্পতিবার বিকেলে। আগুন নেভাতে দমকল বাহিনীর ১১টি ইউনিটের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‍্যাব কাজ করে বলে জানায় দমকল বাহিনী।

১৪ তলা ভবনটির ওপরের দিকে, বিশেষত ১১ তলা থেকে উপরের দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের ১০ ও ১১ তলায় ছিল দু’টি ডেটা সেন্টার- ঢাকা কোলো এবং এনআরবি টেলিকম। এ দু’টি কোম্পানির ওপর ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভরশীল হওয়ায় প্রভাবটা বেশি হয়েছে।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ডেটা সেন্টার সাধারণত খুব সুরক্ষিত রাখা হয়, এখানেও খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

তবে ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ ও জেনারেটর বন্ধ রাখায় সেবা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন ডিভাইস খুলে স্থানান্তরের চেষ্টা চলছে এবং আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে ইন্টারনেট সমস্যা ঠিক হওয়ার আশাবাদ জানান তিনি।

ডেটা সেন্টার একটি ভবনে থাকলে সেটার সব ধরণের নিরাপত্তা বেশ শক্তভাবে নিশ্চিত করতে হয়। সেখানে একটি ভবনে কিভাবে এত বড় অবকাঠামো নির্ভরশীল হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।

ডেটা সেন্টারে কী ছিল?

বাংলাদেশে ইন্টারনেট মূলত আসে সাবমেরিন কেবল থেকে। সাবমেরিনের মধ্য দিয়ে যে ব্যান্ডউইথ আসে আইআইজি বা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়েতে। ইন্টারনেট সেবা দেন যেসব সার্ভিস প্রোভাইডাররা সেখান থেকে ব্যান্ডউইথ কিনে নেয় এবং এরপর গ্রাহক পর্যায়ে সংযোগ দেয়। তেমন কিছু আইআইজির সেন্টার ছিল এই খাজা টাওয়ারে।

আবার মোবাইল যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেভাবে এক অপারেটরের সাথে অন্য অপারেটরের সংযোগের দিকটা যুক্ত থাকে আইসিএক্স বা ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জের সাথে। তেমন দু’টি কোম্পানিও ছিল সেখানে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেছেন, এজন্যই দেশজুড়ে এর প্রভাব পড়েছে কারণ ইন্টারনেটের যে অবকাঠামো তার অনেকগুলোই খাজা টাওয়ার থেকে পরিচালনা করা হচ্ছিল’।

দেশজুড়ে সেই সেবা বিঘ্নিত হওয়ার বিবেচনায় তিনি অবশ্য এটাকে ডেটা সেন্টারের চেয়ে ডেটা ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার বলে বেশি মনে করছেন।

তিনি বলেন, ‘অনেক শক্তিশালী নেটওয়ার্কিং ডিভাইস সেখানে থাকার কথা যার মাধ্যমে ডেটা ডিস্ট্রিবিউশন হবে, ওটা যেহেতু ওখানে ফেইল করেছে ফলে সারা দেশে ডিস্ট্রিবিউশন বিঘ্নিত হয়েছে।’

ঘটনাস্থলে ইন্টারনেট সেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ছিলেন। তারা জানান, এই ভবনটি ছিল একটা হাবের মতো সেখানে ইন্টারনেট সেবাদানকারীদের সংযোগ নির্ভরশীল ছিল।

লিংক-থ্রির নামের একটি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল বিভাগের একজন কর্মকর্তা মো: আশফাকুল আলম ইমন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, একটা ডাটা সেন্টারে সাধারণত বিভিন্ন কোম্পানি তাদের যন্ত্রপাতি বা র‍্যাকগুলোকে মাউন্ট করে, ওখানে সুইচ বসায়, রাউটার বসায়।

তিনি আরো বলেন, ‘তেমন ডাটা সেন্টারে আমরা লিজ নেই। দুই-তিনটা জায়গায় ডাটা সেন্টার আছে। এখানে বাংলাদেশের মধ্যে অনেকগুলো টেলকো, আইএসপি, সবাই মোটামুটি এখানে কানেক্টেড।’

বর্তমানে টেলিকম ও অন্য ডিভাইস অন্যত্র ডেটা সেন্টারে স্থানান্তরের কাজ চলছে বলে জানান তিনি।সেখানে যারা ছিলেন তারা ধারণা দিচ্ছেন ইন্টারনেট সেবার ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বিঘ্নিত হয়েছে।

এমন ডেটা সেন্টারে যেমন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি রাখা হয়, সেগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় বলছিলেন প্রিজমইআরপি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও ইকবাল আহমেদ রাসেল।

তাদের কোম্পানি আইআইজি অপারেশন, ইন্টারনেট সেবাদান ও ডেটা সেন্টারের কাজ করে। ভবনের ১০ তলায় অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো তাদেরও যন্ত্রপাতির একটা অংশ ছিল।

তাদের অন্তত ৫০০ ক্লায়েন্ট বা অ্যাপ্লিকেশন ডাউন অবস্থায় আছে উল্লেখ করে তিনি বলছিলেন, ‘এখানে কিন্তু ৫০০ থেকে এক হাজার কোম্পানি ডাটা রেখে আসছে। এটার প্রভাব কমপক্ষে ছয় মাস থাকবে। যাদের ডাটা লস হবে, যাদের ব্যাকআপ নাই তারা তাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

খাজা টাওয়ার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের গুরুত্বপূর্ণ হাব হওয়ায় রাসেলের ধারণা, এখানে হার্ডওয়ারের যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো হবে।

বিস্মিত মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার

সেই ভবনে অন্তত আটটি আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে), ২৫টি আইএসপির (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) সরাসরি অফিস, আরো ৫০০-এর মতো আইএসপি ক্ষতিগ্রস্ত, দুটি আইসিএক্স প্রতিষ্ঠান ছিল বলে জেনেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার।

তিনি বলেছেন, ‘আমি যখন ডেটাগুলো পেয়েছি তখন আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে যে এই পরিমাণ কানেক্টিভিটির ইকুইপমেন্ট থাকবে সেটা কল্পনারও বাইরে।’

এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারিভাবে পরিচালিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর দায় মূলত ভবনমালিক এবং যারা ঝুঁকি বিবেচনা না করে সেখানে তাদের দামি যন্ত্রপাতি বসিয়েছেন তাদের।

জব্বার জানান, ‘একই ভবনের মধ্যে এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে সেটা জানা ছিল না।’

তিনি আরো জানান, ‘এসব কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়া, তারা সেবা কেমন দিচ্ছে সেদিকটা সরকারের তরফ থেকে দেখা হলেও কোনো ভবন থেকে তারা পরিচালনা করবেন সেটা তাদের দেখার কথা নয়।’

সর্বাধুনিক অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার ঘাটতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সেখানে আগুন লাগতে পারে সেটা কারো মাথায় ঢুকবে না? এটা কোনো কথাই হলো না!’

প্রতিকারের জন্য দ্রুত চেষ্টা চলছে এবং এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আশা করছেন তিনি। এখন থেকে তারা এসব বিষয়েও নজরদারি করবেন বলে জানান তিনি।

সূত্র : বিবিসি