Home জুলাই জাগরণ ‘আয়নাঘরে’ ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করা হয় আসিফ মাহমুদকে

‘আয়নাঘরে’ ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করা হয় আসিফ মাহমুদকে

ট্রাইব্যুনালে উপদেষ্টা আসিফের জবানবন্দি

51
0
‘আয়নাঘরে’ ইনজেকশন পুশ করে

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। সারা দেশে বন্ধ ইন্টারনেট সেবা। সেই রাতেই যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নেয়। মাথায় কালো টুপি পরিয়ে ডিবি পরিচয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে, যা পরবর্তীতে “আয়নাঘর” হিসেবে চিহ্নিত হয়। সেখানে তাকে জুলাই আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য ভিডিও বার্তা দিতে চাপ দেওয়া হয়। রাজি না হলে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলে রাখা হয়।

এই তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেওয়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের জবানবন্দিতে।রাজধানীর চানখারপুলে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় ছয়জন হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ছিল দশম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ। এদিন সাক্ষ্য দেন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও বর্তমান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।

বেলা ২টা ৫০ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্যানেল আদালতকক্ষে প্রবেশ করেন। বাকি দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এরপর সাক্ষীর আসনে ওঠেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। শপথ পাঠ শেষে নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বিস্তারিতভাবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ঘটনা তুলে ধরেন এবং এসব হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস ঘটনার বিচার দাবি করেন।

তিনি বলেন, “আমি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলাম। সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। ২০১৮ সালে এ আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং চাপের মুখে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিল করে। আমি তখনও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলাম।”

তিনি আরও বলেন, “২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে কোটাপ্রথা পুনর্বহাল করেন। এই রায়ের প্রতিবাদে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করি। ঈদের ছুটির পর ১ জুলাই থেকে আবার আন্দোলন শুরু হয়।”

আসিফ জানান, “১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলে। ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পর সেদিন সন্ধ্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। এর প্রতিবাদে সেদিন রাতে ছাত্র-ছাত্রীরা রাজু ভাস্কর্যে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদে মুখর হন।”

তিনি আরও বলেন, “১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ছাত্রলীগই আন্দোলন দমাতে যথেষ্ট। এরপরই ছাত্রলীগ ও বহিরাগতরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী আহত হন, এমনকি ঢাকা মেডিকেলেও হামলা হয়।”

আসিফের বক্তব্য অনুযায়ী, “১৬ জুলাই সারা দেশে প্রতিবাদ হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে রংপুরে আবু সাঈদ নিহত হন। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আরও ছয়জন নিহত হন। ১৭ জুলাই কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা হয়, যা পরে পুলিশের হামলায় বাধাগ্রস্ত হয়।”

তিনি বলেন, “১৮ জুলাই সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করা হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ২৯ জন নিহত হন। রাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় এবং ব্যাপক ধরপাকড় চালায়।”

সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আসিফ বলেন,

“১৯ জুলাই রাতে গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে আমাকে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নেয়। মাথায় কালো টুপি পরিয়ে একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা দিতে বলা হয়। রাজি না হলে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। ২৪ জুলাই সকালে আমাকে সেই স্থানে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। পরে বুঝতে পারি, সেটিই ছিল ক্যান্টনমেন্টের আয়নাঘর।”

তিনি জানান, মুক্তি পাওয়ার পর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি ও নাহিদ ইসলাম। হাসপাতালে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন নজরদারি চালায়, মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়।

বিকেল ৫টা পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। অসমাপ্ত থাকায় ট্রাইব্যুনাল আগামী বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারণ করে।

প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, সহিদুল ইসলাম, মামুনুর রশীদসহ অন্যান্যরা। আসামিপক্ষ ও স্টেট ডিফেন্স আইনজীবীরাও উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র: ইত্তেফাক